Medical Negligence

‘বিচার পাব না?’ প্রশ্ন আর এক বাবার

১০ বছর আগে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ডাক্তারদের গাফিলতিতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কিশোরী কন্যা সুহানা ইয়াসমিনের।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:০৮
Share:
সুহানা ইয়াসমিন

সুহানা ইয়াসমিন —নিজস্ব চিত্র।

‘‘এ আপনাদের কেমন বিচার?’’ স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছেন এক কন্যাহারা পিতা।

Advertisement

১০ বছর আগে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ডাক্তারদের গাফিলতিতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কিশোরী কন্যা সুহানা ইয়াসমিনের। সেই সময়ে স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডাক্তারদের গাফিলতি। তদন্ত রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা হয়েছিল, ডাক্তাররা সে দিন চিকিৎসায় সময় দিলে মেয়েটিকে বাঁচানো যেত। এই স্পষ্ট মন্তব্যের পরেও গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য ভবন ও মেডিক্যাল কাউন্সিলে ঘুরে ঘুরে জুতোর সুকতলা ক্ষইয়ে ফেলেছেন তাঁরা। বিচার পাননি।

স্যালাইন কাণ্ডে চিকিৎসকদের সাসপেনশন, তাঁদের বিরুদ্ধে সিআইডি-র অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর ধারা দেওয়া, প্রকাশ্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসকদের প্রতি তোপ দাগা— এ সব কিছু দেখে দিশাহারা ওই পরিবার। তাঁদের প্রশ্ন, তা হলে কি বিচার নির্ভর করছে প্রশাসন নিজের ইচ্ছেমতো কাদের পাশের দাঁড়াবে, আর কাদের দূরে ঠেলে দেবে, তার উপরে? স্যালাইন কাণ্ডে যেখানে দূষিত স্যালাইন শরীরে প্রবেশ করার কারণেই মৃত্যু বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে যদি দূষিত স্যালাইনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায় ডাক্তারদের ‘গাফিলতি’, তা হলে তাঁর মেয়ের ক্ষেত্রে, যেখানে দফতরের নিজস্ব তদন্তে ডাক্তারদের গাফিলতিই প্রমাণিত হয়েছিল, সেখানে প্রশাসন এত নির্বিকার কেন? সুহানার বাবা রুহুল আমিন মণ্ডল বলেন, ‘‘এতে সাধারণ মানুষের মনে কী প্রশ্ন তৈরি হবে? তাঁরা তো ভাববেন যে, অপরাধটা নয়, কখন কী করলে প্রশাসনের উপরে আর দায় থাকবে না, সেটাই আসল। সেই অনুযায়ীই বিচারের রাস্তা নির্ধারিত হয়। আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, আমার মেয়ের মৃত্যুর সুবিচার দিন। আমার মতো এমন অনেক অসহায় মানুষ বিচারের আশায় আপনাদের দিকে তাকিয়ে।’’

Advertisement

কী হয়েছিল সুহানার? উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ার বাসিন্দা ওই মেয়েটিকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ধাক্কা মেরেছিল লোহার রড বোঝাই একটি ভ্যান। ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বরের ঘটনা। প্রথমে বসিরহাট হাসপাতাল, তার পর আর জি কর ঘুরে সুহানাকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমে। ডাক্তারেরা বাড়ির লোককে বলেছিলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি রক্ত জোগাড় করুন।’’ ১২ বছরের মেয়েটাও বাবাকে বলেছিল, ‘‘তোমরা কেঁদো না। রক্ত দিলেই আমি ভাল হয়ে যাব।’’ তড়িঘড়ি চার বোতল রক্তের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই রক্ত দিয়ে ওঠা যায়নি। অভিযোগ, সুহানাকে রক্ত দেওয়ার সময়ই বার করতে পারেননি চিকিৎসকেরা! কে রক্ত দেবেন, সে নিয়ে পারস্পরিক দায় চাপানোর মধ্যেই ২৭ নভেম্বর মৃত্যু হয় ওই কিশোরীর।

স্বাস্থ্য ভবন তদন্ত কমিটি গড়ে। সেই তদন্ত কমিটি জানায়, যে বিভাগে সুহানা ভর্তি ছিল, সেই প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান-সহ দুই চিকিৎসক এবং পাঁচ জন পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনি এই ঘটনায় দোষী। তাঁরা নিজেদের কাজ করলে মেয়েটিকে মারা যেতে হত না, সে কথাও স্পষ্ট লেখা ছিল ওই রিপোর্টে। তার পরেও ওই ছ’জনকে সতর্ক করা ছাড়া আর কিছু করেনি স্বাস্থ্য দফতর। বলা হয়েছিল, এর পর যা করার মেডিক্যাল কাউন্সিল করবে। স্বাস্থ্য ভবন, নবান্ন, মেডিক্যাল কাউন্সিলে দিনের পর দিন ঘুরেছেন সুহানার পরিবারের সদস্যরা। চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রীকেও। কোথাও কোনও সাড়া পাননি।

স্যালাইন কাণ্ডের পর রাজ্য জুড়ে সোরগোল এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দেখে তাঁরা ফের দ্বারস্থ হয়েছেন প্রশাসনের। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘কেন অকালে বিনা চিকিৎসায় চলে যাওয়া আমাদের মেয়েটা বিচার পাবে না?’’

বর্তমান পরিস্থিতিতে এই চিঠি খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলেছে স্বাস্থ্য কর্তাদের। এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ঘটনাটা মনে আছে। সে সময়ে উপরমহল থেকে বলা হয়েছিল, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে নানা জায়গা থেকে চাপ আসবে। তাই বিষয়টা থিতিয়ে যেতে দেওয়াই ভাল। এখন হয়তো পরিস্থিতি আলাদা। তাই এখন ব্যবস্থাও আলাদা।’’ কোনও বিচার কি পাবে সুহানার পরিবার? তিনি বলেন, ‘‘সবটাই নির্ভর করছে দফতরের সদিচ্ছার ওপরে।’’

সুহানার ঘটনাটি গিয়েছিল মেডিক্যাল কাউন্সিলেও। সে সময় কাউন্সিল জানিয়েছিল, তাদের পেনাল এবং এথিক্যাল কমিটি ওই চিকিৎসকদের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে এবং চার্জ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তার পর কী হল? নুরুল আমিন মণ্ডল জানান, কাউন্সিলের তরফে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। কাউন্সিলের এক কর্তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এখন নানা দিক থেকে আমরা ঘেঁটে আছি। ১০ বছরের পুরনো ঘটনা এখন খেয়াল নেই। খোঁজ করে দেখতে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement