প্রতীকী ছবি।
•ডাক্তারবাবু রোগী দেখলেন। কিছু পরীক্ষানিরীক্ষাও করালেন। তার পর সবিনয়ে জানিয়ে দিলেন, রোগের গতিপ্রকৃতি ঠিক বুঝতে পারছেন না। অন্য কোনও ডাক্তারের কাছে যান। কার কাছে যাবেন? ডাক্তারবাবুর উত্তর, ‘‘সেটা আমি কী করে বলব? খোঁজ-খবর নিয়ে ঠিক করুন।’’
•জটিল অস্ত্রোপচার। খুব দ্রুত করে ফেলা দরকার। তবে অস্ত্রোপচারের ফল কী দাঁড়াবে, তা নিশ্চিত নয়। শহরের নামী এক ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন, এই অস্ত্রোপচার তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কেন? উত্তর মিলল, ‘‘এর জন্য যতটা অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা আমার নেই।’’
নামী বা অল্প নামী, সরকারি বা বেসরকারি— বেশির ভাগ হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে এখন এই ছবি পরিচিত হয়ে উঠছে। রোগীর পরিজনদের হাতে একের পর এক চিকিৎসক নিগ্রহে ডাক্তারদের বড় অংশ এখন এই ‘নিঃশব্দ বিপ্লবে’র পথ ধরছেন। কিছু দিন আগে পরপর চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় এক বার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। পরে তা কেটেও যায়। কিন্তু সম্প্রতি সিএমআরআই এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় হাসপাতালে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনার পরে ডাক্তারদের একটা বড় অংশ ফের এই প্রত্যাখ্যানের তত্ত্ব অনুসরণ করছেন। এক নামী হৃদ্রোগ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অনেকেরই অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বেশ কমে গিয়েছে। মাসিক উপার্জনও কম হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে এ ছাড়া আর উপায় নেই। আর অকারণে আমাদের উপরে হামলার ফল কী হতে পারে, সেটাও টের পাওয়ানোর সময় এসেছে।’’
সোমবার এনআরএসে চিকিৎসক নিগ্রহের জেরে জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের যে গা-জোয়ারি মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তার নিন্দা করেছেন প্রবীণ চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই। তাঁদের বক্তব্য, রোগীর পরিবারের আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু ইমার্জেন্সিতে তালা দিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পদ্ধতিও নিন্দনীয়। পাশাপাশি তাঁদের চিন্তা, ডাক্তাররা কেন এত মারমুখী হয়ে উঠলেন, তা-ও ভাবা দরকার।
স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশও মানছেন, একের পর এক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলা হয়েছে। অথচ পরিকাঠামো যে পর্যাপ্ত নয়, তা সাধারণ মানুষ জানেনও না। তাই হাসপাতালে গেলে যখন প্রায়ই রোগীদের বহু দূরে রেফার করা হয়, তখন তাঁরা মেজাজ হারান। শহরের এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের উপরে নয়। সামগ্রিক ‘সিস্টেম’টার উপরে। সেটা সরকার কতটা বুঝতে পারছে জানি না। কিন্তু এই প্রবণতাটা বাড়তে থাকলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে। তখন তার আঁচটা শুধু ডাক্তারদের উপরে থাকবে না।’’
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। কোথাও কোথাও মাথার উপর ছাউনি নেই, বহু জায়গায় পানীয় জলটুকুও পাওয়া যায় না। কাতারে কাতারে রোগী। এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে কী ভাবে যাবেন, সেটাও অনেকে বুঝতে পারেন না। ক্রমশ তাঁদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। বেসরকারি হাসপাতালে টাকা খরচ করেও যে ভোগান্তি খুব কম হয়, তা নয়। ফলে সাধারণের বিরক্তি, হতাশা বাড়তে থাকে। ডাক্তারদের সামনে পেয়ে তাই এখন মানুষ তাঁদের উপরেই সবটা উগরে দিচ্ছেন।’’
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’-এর মুখপাত্র রেজাউল করিম মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন প্রকাশ্যে চিকিৎসকদের তিরস্কার করেছিলেন, সে দিনই সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন, যে ডাক্তারদের সঙ্গে যা খুশি করা যায়। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীও নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই এ বার তাঁকেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’
গত সোমবার, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসকদের উপরে হামলার সাতটি ঘটনা ঘটেছে। এই প্রবণতা চলতে থাকলে সেটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা নিয়ে শঙ্কিত স্বাস্থ্য কর্তারাও। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘নানা জায়গা থেকে খবর আসছে, ডাক্তাররা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে চাইছেন না। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্র এক অবস্থা। সরকারি হাসপাতাল থেকে রেফারের ঘটনা এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছে। মাঝে এ রাজ্য থেকে মুম্বই বা চেন্নাই, ভেলোর যাওয়ার প্রবণতা খানিকটা কমেছিল, এখন আবার তা বাড়ছে। আমরা বোধ হয় ক্রমশ পিছনের দিকে হাঁটছি।’’