অসহায়: বিষমদে মৃত মদন সাউয়ের মা ও স্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
ঘটনা তো কতই ঘটে। কতগুলিরই বা বিচার হয়।
মঙ্গলবার সকালে এমনই আক্ষেপ শোনা গেল দাসপুরের ভূতা গ্রামের দীপালি রানা ও মাধবী সাউয়ের মুখে। আট বছর আগে চোলাই খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁদের স্বামী-সহ চারজনের। অভিযোগ, বিচার তো দূর। এ ক্ষেত্রে সে ভাবে নাকি কোনও তদন্তই হয়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরে বিষ মদ-কাণ্ডে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে চারজনের। তারপরই হা হুতাশ বেড়েছে দীপালি, মাধবীদের। তাঁরা বললেন, ‘‘রাজনৈতিক দল বা পুলিশ কেউই আমাদের কথা ভাবেনি। দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গিয়েছে। বহুবার পুলিশ-প্রশাসনের দোরে দোরে ঘুরেছি। কেউ ভ্রূক্ষেপও করেনি।”
তদন্ত যে একেবারে হয়নি তা নয়। চারজনের মৃত্যু হলেও, মাত্র একজনের ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হয়েছিল। সেই সূত্রেই শুরু হয়েছিল মামলা। কিন্তু পরে সে মামলা তুলে নেওয়া হয়। কেন এমন হল? মামলার অন্যতম সাক্ষী ভূতা গ্রামেরই বাসিন্দা হারাধন প্রামাণিক বললেন, ‘‘অভিযুক্তই তো বিষ মদ খেয়ে মারা গিয়েছিল। কার বিরুদ্ধে মামলা চলবে?”
ভূতা গ্রামের মদন প্রামাণিক পড়শি গ্রাম থেকে চোলাই কিনে এনেই মদ বেচতেন। বাড়িতেই ছিল ঠেক। সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে ভিড় করত নেশাড়ুরা। বিক্রি করার পাশাপাশি মাঝে মাঝে নিজেও নেশা করতেন মদন। বছর আট আগে ডিসেম্বরের এক সকালে সেই ঠেকে জড়ো হয়েছিলেন জনা দশেক বাসিন্দা। কিছুক্ষণ পরই বিষ মদের প্রভাব পড়েছিল প্রত্যেকের শরীরে। মদ খেয়েই এমনটা হচ্ছে প্রথমে টের পাননি কেউ। নিজেদের মতো করে চিকিৎসাও শুরু করেছিলেন। একসময় কেউ নার্সিংহোমে কেউ আবার ঘাটাল হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। জনা চার-পাঁচেক চিকিৎসায় সুস্থ হলেও মারা গিয়েছিলেন চোলাই বিক্রেতা মদন, দীপালির স্বামী শিবসাধন রানা, মাধবীর স্বামী মদন সাউ এবং স্থানীয় সাহাচক গ্রামের এক যুবক। মৃতদের মধ্যে একমাত্র মদন সাউয়ের ময়নাতদন্ত হয়েছিল।
ঘটনার পরই ধড়পাকড় শুরু হয়েছিল গ্রাম জুড়ে। পাশাপাশি একাধিক মদ বিক্রেতাকে পুলিশ ও আবগারি দফতর গ্রেফতার করেছিল। শুরু হয়েছিল মামলা। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল মৃতদের পরিবারগুলিকে। কিন্তু মাঝপথেই থমকে যায় সবকিছু। একসময় ঘাটাল আদালত থেকে মামলাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দেওয়া হয়নি কোনও ক্ষতিপূরণও। হারাধন বললেন, “আচমকাই আমাকে বলা হয়েছিল এই মামলা বন্ধ হয়ে যাবে। সাক্ষ্য দিতে আর আসতে হবে না।” তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূতা গ্রামের কয়েকজন যুবক বললেন, “এর পেছনে অন্য গল্প ছিল। লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা চলেছিল সেই সময়। মদ ব্যবসায়ীরা মুখ বন্ধ করতে সরাসরি আসরে নেমেছিল। পুলিশ ও আবগারি দু’পক্ষই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।”
এ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চাননি জেলার পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। তবে জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নেব। কোনও বঞ্চনা হয়ে থাকলে সেই বিষয়টিও দেখব।” আবগারি কর্তা একলব্য চক্রবর্তী বললেন, “বিষয়টি শুনেছি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।” তৃণমূলের দাসপুর-২ ব্লক সভাপতি তথা ওই পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি আশিস হুতাইত বললেন, “বহু পুরানো ঘটনা। কিছু উপায় থাকলে নিশ্চয়ই করব।”
সংগ্রামপুরে বিচার মিলেছে। আট বছরের প্রতীক্ষা আর প্রতিদিনের সংগ্রাম নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন দীপালি, মাধবীরা।