covid vaccine

করোনা টিকার আবাহনের দিন বিয়োগ বিসর্জন মনে পড়ছে ওঁদের

এ দিন আরও বেশি করে বোনের কথা মনে পড়ছে সন্ধ্যার। গলায় হতাশা, ‘‘টিকাও যদি ভাগ করে নিতে পারতাম!’’

Advertisement

সুমন রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১ ২১:২২
Share:

টিকা অভিযানের শুরুতে ফিরে আসছে স্বজন হারানোর স্মৃতি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

শনিবার দেশ জুড়ে শুরু হল করোনার টিকা অভিযান। দিল্লিতে এমস হাসপাতালের সাফাইকর্মী মণীশ কুমার প্রতিষেধকের প্রথম ডোজটি নিলেন। কিন্তু টিকাকরণ শুরু মানেই, পিছু ছাড়ছে না ভাইরাস। ঠিক যে রকম ভাবে স্বজন-হারানোর স্মৃতি পিছু ছাড়ছে না দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ, লক্ষাধিক পরিবারকে।

Advertisement

মঞ্জুলা ঘোষ। বয়স ৮৭। অশীতিপর মঞ্জুলা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন গত ১৫ ডিসেম্বর। অথচ সেই বিদায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তাঁর ছেলে-মেয়ে। বয়স আশির কোঠা পেরিয়ে গেলেও তেমন ভাবে কোনও অসুখ ছিল না তাঁর। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ারও বিশেষ লক্ষণ ছিল না শরীরে। জ্বর এসেছিল। তাই ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। নিজেই গটগট করে হেঁটে হাসপাতালে ঢুকে গিয়েছিলেন তিনি। ঢোকার মুখে হাসিমুখে মেয়ে, সুভাগতাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘চিন্তা নেই, জলদি ফিরব।’’ ফেরেননি মঞ্জুলা।

শনিবার যখন দেশে কোভিডের টিকাকরণ শুরু হল, কী ভাবছেন সুভাগতা? কী মনে পড়ছে তাঁর? টিকাকরণ কতটা আগে হলে ভাল হত? সকাল থেকেই সংবাদমাধ্যমে টিকাকরণের খবর শুনেছেন তিনি। মনে হয়েছে, এই দিনটা আর মাসখানেক আগে এলেই হয়তো, যে ভাবে হাসতে হাসতে হাসপাতালে ঢুকেছিলেন মঞ্জুলা, সে ভাবেই বেরিয়ে আসতেন। তাঁর কথায়, ‘‘মা বেরিয়ে এলেন প্লাস্টিকের ব্যাগে। সেই স্মৃতিটা নিয়েই বাকি জীবন থাকতে হবে। যদি তার আগে টিকা এসে যেত...।’’ এখনও আপশোস তাঁর গলায়।

Advertisement

একই রকম আপশোস চন্দনগরের সন্ধ্যা ঘোষের গলাতেও। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বোন মালতি চলে গিয়েছেন কয়েক মাস আগে। ছোট থেকে দুই বোন একসঙ্গে বড় হয়েছেন। সব কিছু ভাগ করে নিয়েছেন। কোলেপিঠের বোনের কথা এ দিন আরও বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর। সন্ধ্যার গলায় হতাশা, ‘‘ছোট থেকে সব কিছু ভাগ করে নিয়ে দুই বোন। ক’দিন পরে হয়তো আমি কোভিডের টিকা নেব। সেটাও যদি ভাগ করে নিতে পারতাম!’’

টিকাকরণের প্রথম দিনেও আছে বিষণ্ণতা। ছবি: পিটিআই

একই জিনিস মনে হয় চিত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায়রও। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। তা-ও আবার ফুসফুস-হৃদযন্ত্রের। নিজের চিকিৎসা প্রায় নিজেই করতেন রমেন্দ্রনারায়ণ হাজরা। রিপোর্ট হাতে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফোন করে মেয়েকে বলতেন, ‘‘আজ রিপোর্ট ভাল রে মা! ইমপ্রুভ করছি।’’ যে দিন সমস্যা হত, সে দিনও নিজেই জানিয়ে দিতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

রমেন্দ্রনারায়ণ ‘ইমপ্রুভ’ করেননি। আজকের দিনটায় কেমন লাগছে? প্রশ্ন শুনে চিত্রলেখা বললেন, ‘‘বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না! বাবা নিজে চিকিৎসক ছিলেন। তাই বহু বার টিকা নিয়ে কথা হয়েছে বাবার সঙ্গে। বাবা বলতেন, এত তাড়াতাড়ি টিকা আসতে পারে না। অনেক সময় ধরে ট্রায়াল দরকার।’’ বাবা নেই, টিকা কয়েক মাস আগে এলে, হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হত। তবু টিকা নিয়ে সংশয়ে চিত্রলেখা। তাঁর মতে, ‘‘আরও কিছু দিন ট্রায়াল দিয়ে তবে টিকা আনলেই তো ভাল হত। এত তড়িঘড়ি করতে গিয়ে, যদি হিতে বিপরীত হয়! যদি আরও বহু মানুষকে অন্য সমস্যায় স্বজন হারাতে হয়!’’

তবে এমন কোনও সংশয় নেই সম্রাজ্ঞী কোনারের। তাঁর বাবা সুভাষচন্দ্র কোনারও মারা গিয়েছেন করোনা সংক্রমণে। বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনে সম্রাজ্ঞী স্বাস্থ্য দফতরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। দাবি ছিল, টাকাপয়সা চাই না, বাবাকে ফিরিয়ে দিতে হবে! শনিবার যখন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোরদার হাতিয়ার প্রয়োগ শুরু এল, তখন কী ভাবছেন সম্রাজ্ঞী? কতটা দেরি হয়ে গেল তাঁদের? সম্রাজ্ঞী বলছেন, ‘‘গত বছরের গোড়ায় তাঁর বাবা টিকিট কেটেছিলেন এ বছর দক্ষিণ ভারত বেড়াতে যাবেন বলে। আমরা তিন জন। জুলাই মাসের শেষে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে টিকিটের প্রিন্ট আউট হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে দেখতেন তিনি। তার মাস খানেক আগে যদি টিকা এসে যেত, হয়তো এখন দক্ষিণ ভারতের জন্য ব্যাগ গোছাতেন উনি।’’ বহু প্রচেষ্টার পরেও টিকা আসতে এত দেরি হল কেন, তা নিয়ে আক্ষেপ সম্রাজ্ঞীর গলায়।

স্বজন হারানোর শোক পিছু ছাড়ছে না পরিবারের। ছবি: রয়টার্স

যাঁরা চলে গিয়েছেন, এ ভাবেই তাঁদের স্মৃতি আরও বেশি করে ফিরে আসছে এই টিকা অভিযানের প্রথম দিনটায়। আরও বেশি করে তাঁদের ঘর খালি লাগছে রুখে দাঁড়ানোর প্রথম দিনটায়। দিনটার গুরুত্ব বলতে গিয়ে, বার বার একটা কথাই বলে ফেলছেন তাঁরা, ‘‘ইস! যদি আর কয়েক মাস আগে এই দিনটা আসত!’’

আরও পড়ুন: জেলায় জেলায় বিভিন্ন কেন্দ্রে চলছে টিকাকরণের কাজ

আরও পড়ুন: ন্যাতা-বালতি ধরা হাতে ডাক্তারদের আগেই টিকা পেলেন মুন্না-সঞ্জয়-চন্দনরা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement