ধৃত: আদালতে রাজদীপ। বৃহস্পতিবার, বারাসতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ
কখনও পানশালার লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার নামে, কখনও নিজেকে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বধূ নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত, সরকারি চাকরি করেন এমন ব্যক্তিদের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতানোতেও অভিযুক্ত সে। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ৫০ জনেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে রাজদীপ দাস নামে ওই যুবককে গ্রেফতার করল দত্তপুকুর থানার পুলিশ।
রাজদীপের ধরা পড়ার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বারাসত আদালতে ভিড় করেন বহু মানুষ। তাকে জেরা করে আরও অনেক তথ্য মিলবে বলে পুলিশি হেফাজতের দাবি জানান প্রতারিতদের পক্ষের আইনজীবী সমর ঘোষাল। অভিযোগের গুরুত্ব বিচার করে বিচারক সন্দীপ চক্রবর্তী রাজদীপের ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বারাসতের কাছে বামনগাছির মণ্ডলগাঁতির বাসিন্দা বছর তিরিশের রাজদীপের দোলতলা-সহ বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাট এবং প্রচুর গাড়ি রয়েছে। তার নামে আগেও একাধিক প্রতারণার অভিযোগ হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সাহায্যে সে নানা ভাবে তা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবি, এলাকায় বন্যার সময়ে সাহায্য করে, প্রতি বছর বহু টাকা খরচ করে সরস্বতী পুজো করে, স্থানীয় মানুষদের খাইয়ে, বস্ত্র বিতরণ করে সে রবিনহুডের মতো ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে, কখনও কৌশিক, কখনও তাপস নামে পরিচয় দিয়ে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে রাজদীপের বিরুদ্ধে।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, সম্প্রতি খড়দহের বাসিন্দা বিধানচন্দ্র রায় নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার রাতে গ্রেফতার করা হয় রাজদীপকে। তার বিরুদ্ধে ৬২ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন বিধানবাবু। এ দিন বারাসত আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত একটি মামলার জন্য আমি খড়দহ থানায় যাই। সেই সময় থানার এক জন আমাকে বলেন, রাজদীপ সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের আইনজীবী। তিনি রাজদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এর পরে রাজদীপ ওই মামলা জিতিয়ে দেবে এবং মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রচুর টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ধাপে ধাপে ৬২ লক্ষ টাকা নেয়।’’ এ কথা থানায় দায়ের করা অভিযোগেও জানিয়েছেন বিধানবাবু।
বৃহস্পতিবার বিচারক নিজেই এজলাসে প্রশ্ন করেন, রাজদীপ কি আইনজীবী? এজলাসের লকআপ থেকে মাথা নেড়ে না বলে রাজদীপ। প্রতারিত পক্ষের আইনজীবী সমরবাবু অভিযোগ করেন, ‘‘ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে, নানা অছিলায় অসহায় মানুষদের প্রভাবিত করে প্রায় ৫০ জনের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে রাজদীপ। পুলিশি জেরার পরে এ বিষয়ে আরও জানা যাবে।’’
এ দিন আদালতে হাজির হন নিমতার বাসিন্দা দীপঙ্কর সরকার। তিনি বলেন, ‘‘আইনি জটিলতায় আমার পানশালা বন্ধ রয়েছে। সেটি খুলে দেওয়ার নাম করে আমার থেকে ধাপে ধাপে ৫৪ লক্ষ টাকা নিয়েছে রাজদীপ। টাকা চাইতে গেলে উল্টে ভয় দেখাচ্ছে।’’ উজ্জল সেন নামে এক যুবকের অভিযোগ, ‘‘আমার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় ৫০ লক্ষ টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ১৭ লক্ষ টাকা নিয়েছে রাজদীপ।’’ জালিয়াতির কাজে রাজদীপ অনেক সরকারি কাগজপত্র জাল করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ দিন বামনগাছির স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, শুধু এলাকারই নয়, প্রশাসনের কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে রাজদীপের ওঠা-বসা ছিল। এ সবের সুযোগে এলাকায় সমাজসেবীর ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল রাজদীপ। কখনও বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ সাহায্য, কখনও স্থানীয় ক্লাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অকাতরে অর্থ ব্যয় করত সে। ফলে ওই এলাকায় গিয়ে কেউ তার টিকি ছুঁতেও সাহস করত না।