২১-এর মঞ্চে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
যে প্রশ্নে সবচেয়ে কড়া মনোভাব নিচ্ছেন তিনি ইদানীং, সেই তোলাবাজি বা সিন্ডিকেট প্রসঙ্গের উচ্চারণই শোনা গেল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। একুশে জুলাইয়ের মঞ্চকে মূলত একটি তিরস্কারের মঞ্চ বানাতে চাইলেন না তিনি। হালকা ধমক রইল বটে। কিন্তু কর্মী-সমর্থকদের সামনে প্রধানত পরবর্তী রাজনৈতিক লক্ষ্যটা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার মঞ্চ হিসেবেই এই দিনটাকে ব্যবহার করলেন তৃণমূল নেত্রী।
একুশে জুলাই তাঁর দলের জন্য অন্যতর তাৎপর্যের একটি দিন। শহিদ তর্পণের সমাবেশ। কর্মী-সমর্থকদের আবেগ সম্পৃক্ত এই কর্মসূচিতে। সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, দুর্নীতি, মাতব্বরি নিয়ে খুব বেশি কঠোর শব্দ প্রয়োগের রাস্তায় তাই হাঁটলেন না মমতা বন্দ্যোপাধায় এ দিন। ‘লোকের কাছ থেকে টাকা তুলে দল চালাতে চাই না’, অথবা ‘মানুষের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে বরদাস্ত করব না’, অথবা ‘দু-একটা লোক একটু-আধটু খারাপ কাজ করে আর তাদের জন্য গোটা দলটার বদনাম হয়’— এই রকম কিছু কথার মধ্যে মৃদু ধমক একটা রইল। কিন্তু শহিদ তর্পণের কর্মসূচিতে ডেকে এনে কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে এমন কিছু বললেন না, যাতে মনে হয় গোটা দলটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। এমন বার্তা দিলেন না, যাতে সদ্য ভোটযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে আসা লক্ষ লক্ষ অনুগামীদের মনোবলে চিড় ধরে।
কর্মী-সমর্থকদের অটুট মনোবলটা এখন আরও বেশি দরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কারণ তিনি নিজের রাজনৈতিক মানচিত্রটা এ বার প্রশস্ত, প্রসারিত করতে চাইছেন। শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকেই স্পষ্ট হল সে কথা। তৃণমূল নেত্রী বুঝিয়ে দিলেন, রাজ্যের বাইরেও এ বার বেশ মজবুত ভাবেই পা ফেলতে চাইছেন তিনি। গড় ইতিমধ্যেই সুরক্ষিত। এ বার সাম্রাজ্য বিস্তারের পালা। দিল্লিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এ বার।
দিল্লি যে পরবর্তী লক্ষ্য, তা সরাসরি বলেননি অবশ্য। কিন্তু মঞ্চটা বেশ সংহত ভঙ্গিতেই প্রস্তুত করলেন মমতা। রাজধানীর রাজনীতিতে পোড় খাওয়া দুই সতীর্থকে দিয়ে পটভূমিটা তৈরি করালেন প্রথমে। নিজের ভাষণে তারই রেশ টেনে কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণে গেলেন। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ছুড়ে ফেলা হবে বলে প্রত্যয় প্রকট করলেন। আর তার সঙ্গেই উচ্চারণ করলেন এক বিকল্পের প্রস্তাবনা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঞ্চলিক দলগুলিরই শক্তিশালী হওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন। নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে চান না, বরং বন্ধুভাবাপন্ন এবং সহযোগী দলগুলিকে সাহায্য করতে চান বলে মন্তব্য করলেন।
রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণ বার্তা। মমতার এই বার্তা কিন্তু শুধু কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে নয়। জাতীয় রাজনীতিতে আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যে সব শক্তি, তাদের সবার জন্যই বার্তা নিহিত রইল মমতার এ দিনের ভাষণে।
প্রথমত, তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইলেন বিপুল জনাদেশ নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেও, বিভিন্ন আঞ্চলিক মহারথীদের সম্মিলিত প্রয়াস বিকল্প হয়ে উঠতেই পারে। বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, ধুঁকতে থাকা কংগ্রেসকে দেখে এখনও এই বিজেপির বিকল্প বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু বাংলায় তিনি নিজে, উত্তরপ্রদেশে দ্রুত এগোতে থাকা মায়াবতী, দিল্লির পর পঞ্জাবের মতো রাজ্যে বিজেপির গড়ে ফাটল ধরিয়ে দেওয়া আম আদমি পার্টি, বিহারের নীতীশ কুমার, ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, তেলঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও, অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু, তামিলনাড়ুর জয়ললিতা এবং আরও অনেক ছোট-বড় শক্তি একত্রিত হলে ২৮২-র বিজেপি-কেও টক্কর দেওয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, মমতা প্রথমেই প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড় থেকে সরিয়ে রাখলেন নিজেকে। বোঝাতে চাইলেন, শক্তিশালী বিকল্পটাই তাঁর কাছে সর্বাগ্রে কাম্য। প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে ভাবেন না। এই বার্তায় আঞ্চলিক শক্তিগুলির প্রস্তাবিত একত্রীকরণ সহজতর হয়। মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন বলে অন্য সব আঞ্চলিক দলকে পাশে চাইছেন, এমন বার্তা মিলনের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই শেষ করে। তাই শুরুতেই নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। মমতা বিলক্ষণ জানেন, আঞ্চলিক শক্তিগুলির জোট সত্যিই মসনদের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে, ৩৪ বা তার চেয়েও বেশি আসনের তৃণমূল সেখানে স্বাভাবিক গতিতেই অন্যতম বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড় তখনও শুরু হতেই পারে।
জাতীয় রাজনীতিতে যে বৃহত্তম মঞ্চ এখন কাঙ্খিত তাঁর কাছে, শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকেই তার শিলান্যাসটা সেরে ফেলতে চাইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পারলেন কি? উত্তর দেবে সময়।