সদলবলে: সাতজনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে জঙ্গলখাসে ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক। ফাইল চিত্র।
বাড়ির দাওয়ায় ঝিম মেরে বসেছিলেন বছর চুয়ান্নোর বাসনা শবর। কাছে যেতেই নাকে এল দেশি মদের গন্ধ। বাসনার ছেলে শিবু কাশতে কাশতে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তবু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান না। বাসনা বললেন, ‘‘একটু আধটু নেশা অনেকেই তো করে।’’ জানা গেল, এক বোতল মদ মেলে ৩০ টাকায়।
বছর দু’য়েক আগে শিবুর স্ত্রী কুলো শবরের মৃত্যু হয়েছে। পড়শি এক মহিলা বললেন, ‘‘বাসনার বউমাটা তো নেশা করেই মরল।’’
১৫ দিনের মধ্যে সাত-সাত জনের মৃত্যু শিরোনামে নিয়ে এসেছে লালগড়ের পূর্ণাপাণি এলাকার জঙ্গলখাস গ্রামের শবরপাড়াকে। ব্লক স্বাস্থ্য দফতরের সমীক্ষা বলছে, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন শবররা। কমে যাচ্ছে শবরদের গড় আয়ু। শুধু পূর্ণাপাণি নয়, আশপাশের করমশোল, রাঙামেটা, রাউতাড়ার মতো গ্রামগুলিতে শবরদের কঙ্কালসার চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
আরও পড়ুন: কতটা ফাঁপা উন্নয়ন, বোঝা যাচ্ছে মৃত শবরদের গ্রামে পা রাখলেই
মদের ভাটির জন্য গ্রামবাসীদের ক্ষোভ পুলিশ ও আবগারি দফতরের বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ, পূর্ণাপাণি ও লাগোয়া এলাকায় প্রায় ৭০টি বেআইনি ভাটি চলছে। বহু ক্ষেত্রে শবররা বাড়িতে মদ তৈরি করছেন। অথচ কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। লালগড় ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শ্যামল মাহাতোও মানছেন রমরমিয়ে ভাটি চলার কথা। আর তৃণমূলের পূর্ণাপাণি বুথ সভাপতি ধ্রুবরাজ মাহাতোর মন্তব্য, “শবরদের নেশামুক্ত করে জীবনের মূলস্রোতে ফেরাতে পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা জরুরি। আমরাও নেশামুক্ত শবর সমাজ গড়ে তুলতে চাই।”
কিন্তু সেই সচেতনতা থেকে বহু দূরে শবরপাড়া। নেই সচেতনতা তৈরির বাড়তি উদ্যোগও।
আরও পড়ুন: লালগড়ের ‘শিক্ষা’, সবংয়ে শবরপল্লি পরিদর্শন
পূর্ণাপাণি থেকে কিলোমিটার খানেক গেলেই তাড়কি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্থানীয়রা বলছেন, সপ্তাহে তিন দিন সোম, বুধ, শুক্র উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র খোলা থাকার কথা। কিন্তু সব দিন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র খোলা থাকে না। কথা বলতে যেতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী (এএনএম) স্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, “আমি কিছুই বলব না।” তাড়কি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের আওতায় রয়েছে পূর্ণাপাণি সহ ১৫টি গ্রাম। যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা মাত্র ৪ জন। তারপর মধ্যে শবর ছিলেন মাত্র একজন। সেই মঙ্গল শবরের সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে। আশাকর্মী রেখা মাহাতো, শম্পা সেন চৌধুরীরাও বললেন, “শবররা সব সময় নেশায় ডুবে থাকে। কথা শোনে না।”
পূর্ণাপাণি থেকে কিছুটা দূরে করমশোলে গিয়ে দেখা গেল, ত্রিপল ঘেরা বাঁশের ঝুপড়িতে শুয়ে আছেন বছর চল্লিশের ফটিক শবর। ফটিক মানলেন, ‘‘মদ ছাড়লেও মদ আমাকে ছাড়ছে না।’’ বাড়িতে শুয়ে ছিলেন বছর তিরিশের রাই শবর। কাশলে রক্ত বেরোয়। লালগড় ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি বনবিহারী রায় বলেন, ‘‘গ্রামে গ্রামে আখের গুড় আর ইউরিয়া দিয়ে চোলাই তৈরি হচ্ছে। ওই বিষ মদে শবররা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখনই প্রশাসন সতর্ক না হলে আরও শবরের মৃত্যু হবে।’’ ঝাড়গ্রাম জেলার আবগারি সুপার মিলন বিশ্বাস অবশ্য এ দিন ফোন ধরেননি।