দায়িত্ব নিয়েই রাজ্যকে কৌশলী বার্তা কেশরীর

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই কৌশলে রাজ্য সরকারকে বার্তা দিলেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর বক্তব্য, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি এবং কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নইলে তার শেষ পরিণতি বিশৃঙ্খলা। ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদেরও এই দায়িত্বের কথা নির্দিষ্ট ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নতুন রাজ্যপাল। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশে রাজ্যপালের বক্তব্য, হিংসা-সংঘর্ষ নয়। একে অপরের প্রতি সহনশীল হোক তারা। অন্যের কথা শোনার অভ্যাস রপ্ত করা দরকার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:২১
Share:

রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর শপথের পর রাজভবনের চা-চক্রে রাহুল সিংহ ও মুখ্যমন্ত্রী।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই কৌশলে রাজ্য সরকারকে বার্তা দিলেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর বক্তব্য, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি এবং কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নইলে তার শেষ পরিণতি বিশৃঙ্খলা। ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদেরও এই দায়িত্বের কথা নির্দিষ্ট ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নতুন রাজ্যপাল। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশে রাজ্যপালের বক্তব্য, হিংসা-সংঘর্ষ নয়। একে অপরের প্রতি সহনশীল হোক তারা। অন্যের কথা শোনার অভ্যাস রপ্ত করা দরকার।

Advertisement

রাজভবনে বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরেই সাংবাদিকদের কাছে যে কথা রাজ্যপাল ত্রিপাঠী বলেছেন, তাকে এ রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির নিরিখেই ব্যাখ্যা করতে চাইছে বিরোধী শিবির এবং প্রশাসনিক মহলের একাংশ। তাদের বক্তব্য, এ রাজ্যে একের পর এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ইদানীং কালে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রধান পদ থেকে প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইস্তফার পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ চালাচ্ছেন রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। বিচার বিভাগের কোনও ব্যক্তিত্বের জায়গায় মানবাধিকার কমিশনের মাথায় প্রাক্তন পুলিশ-কর্তাকে বসানো নিয়ে সরব বিরোধীরা। আবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে মীরা পাণ্ডের অবসরের পরে সেখানে আনা হয়েছে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে। যে পদে বরাবর আইএএস অফিসারদের দেখা যেত, সেখানে এ বার ডব্লিউবিসিএস অফিসারকে আসীন হতে দেখে ওই পদের গুরুত্ব লঘু হওয়ার আশঙ্কাই করেছেন প্রশাসনিক কর্তা ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ। তথ্য কমিশনও এখন দুর্বল। আবার পুলিশ-প্রশাসনের উপরে নিরন্তর প্রভাব খাটিয়ে শাসক দলের একের পর এক নেতা-নেত্রীর নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ এসেছে।

এই ঘটনাবলি মাথায় রেখে রাজ্যপালের এ দিনের মন্তব্যে রাজ্যের প্রতি কৌশলে কড়া বার্তা বলেই মনে করা হচ্ছে। শপথের পরে রাজভবনে এ দিন রাজ্যপালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন কী? রাজ্যপাল প্রথমে বলেন, “ওঁর সম্পর্কে আর কী বলব?” তার পরেই তিনি যোগ করেন, “শাসক দল বা বিরোধী পক্ষ, প্রত্যেকের উচিত সাংবিধানিক কাঠামোগুলিকে শ্রদ্ধা করার অভ্যাস তৈরি করা। যদি এই অভ্যাস তৈরি না করা যায়, তা হলে শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলারই সৃষ্টি হয়। সকলকেই সংবিধানে বলা বিষয়গুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত। শাসন ক্ষমতায় যাঁরা রয়েছেন, এটা তাঁদেরও দায়িত্ব।”

Advertisement


শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের নয়া রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর
সঙ্গে হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়।

দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাজ্যপালের প্রথম দিনের মন্তব্য ঘিরেই অবশ্য কোনও সংঘাতে জড়াতে চায়নি রাজ্য সরকার তথা শাসক দল। বিরোধীরাও সরাসরি রাজ্যপালের কথার উপরে মন্তব্য করেনি। তবে বিরোধী নেতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাংবিধানিক এক্তিয়ার মেনে রাজ্যপাল কাজ করবেন এবং সরকারকেও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে বলবেন, এটাই তাঁদের প্রত্যাশা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “রাজ্যপাল কী বলেছেন, না শুনে মন্তব্য করতে চাই না। তবে রাজ্যপাল-সহ প্রত্যেকের দায়িত্বই সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। সংবিধান মেনে সকলে কাজ করবেন, এটা সব সময় মনে করি।” আর রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে নতুন রাজ্যপাল অবহিত বলে জানিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “যা উচিত মনে করেছেন, তা-ই উনি বলেছেন। রাজ্যের পরিস্থিতি তিনি জানেন।”

হাওড়া স্টেশনে বুধবারই রাজ্যপাল ত্রিপাঠীকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

রাজভবনেও এ দিন তিনি ছিলেন। পার্থবাবুর বক্তব্য, “সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে রাজ্যপাল কাজ করবেন এবং রাজ্যের উন্নয়নে সহযোগিতা করবেন, এটাই আমাদের বিশ্বাস। রাজ্যও নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সহযোগিতা করবে।” রাজ্যপালও জানিয়েছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে রাজ্য তাঁর সহযোগিতা চাইলে তিনি কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিহিত করার চেষ্টা করবেন।

বাম ও কংগ্রেস রাজ্যপালের শপথ অনুষ্ঠানে ছিল না। প্রাথমিক ভাবে ধারণা হয়েছিল, বিরোধীরা অনুষ্ঠান বয়কট করেছে। জবাবে রাজ্যপালও বলেন, “জানি না ওঁরা কেন আসেননি! কিন্তু না এলে আমিই বা ওঁদের চিনব কী করে, ওঁরাই বা আমাকে জানবেন কী ভাবে! বুঝলাম না, বয়কটের পিছনে কারণ কী। ওঁরা এ-সব নিয়েই সুখে থাকুন!” ঘটনা হল, আমন্ত্রিত বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু ও বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু দু’জনেই ছিলেন উত্তরবঙ্গে। তাই রাজভবনে থাকতে পারেননি। সূর্যবাবু জানান, বয়কটের প্রশ্নই নেই। তবে কংগ্রেসের অভিযোগ, তারা আমন্ত্রণ পায়নি। মানস ভুুঁইয়ার কথায়, “পরিষদীয় দলের কাছে আমন্ত্রণপত্র আসেনি। অন্য বার আসে। জানি না কেন রাজ্য বা রাজ্যপাল কংগ্রেসকে অস্পৃশ্য মনে করলেন!”

রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় দল পাঠানো নিয়েও রাজ্যপালের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “যে কোনও ধরনের হিংসাই নিন্দনীয়। সব দলেরই প্রধান কাজ বিরোধী মতের প্রতি সহনশীলতার কথা বলা এবং সেইমতো আচরণ করা। যদি রাজনৈতিক দলগুলি অন্য পক্ষের মত শোনার অভ্যাস গড়ে তোলে, তা হলে বিবাদের সমাধান বেরিয়ে আসবে। সংঘর্ষ বা হিংসা সমস্যার সমাধানের পথ হতে পারে না।” বিরোধীদের মতে, এই মন্তব্যেও শাসক দলের প্রতি কৌশলী বার্তা আছে রাজ্যপালের। কারণ বিরোধী দল-সহ যে কোনও বিরূপ মতামতের প্রতি অসহিষ্ণুতার অভিযোগ বারবার উঠেছে বর্তমান শাসক পক্ষের বিরুদ্ধে।

ত্রিপাঠীর মতে, রাজ্যপালের কাজ কারও সঙ্গেই বিবাদে জড়িয়ে পড়া নয়। বিতর্ক হলে তিনি আলাপ-আলোচনার পথই নেবেন। তবে এখনই এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন একদা উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার দু’বারের স্পিকার, ইলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী। নতুন রাজ্যপাল বরং এখন বাংলাকে চিনতে চান। বাংলার মূল সমস্যার কথা বুঝতে চান। আর চান সংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সেই সমস্যার সমাধান। তিনি বলেন , “আমি কম কথার লোক। আইনজ্ঞ হিসাবে জানি, কখন কথা বলতে হয়, কী বলতে হয়, আর কী বলা উচিত নয়। দেশের সংবিধানেই রাজ্যপালের ভূমিকার কথা বলে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের সেই চৌহদ্দির মধ্যেই আমি থাকব এবং সেই মতো কাজ করব।”

—নিজস্ব চিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement