কুকুর তুমি কার?
যে সারমেয়টিকে কেন্দ্র করে রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতালের অধিকর্তাকে বদলি হতে হল, ওই স্বাস্থ্যকর্তা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে শাস্তির মুখে পড়লেন, রাজ্যের তিন চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের দাবি উঠল, সেই প্রাণিটির মালিক আসলে কে? আপাতত সেই প্রশ্নে রাজ্য তোলপাড়।
এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের নথিতে তার কোনও নাম নেই। নেই ঠিকানা বা মালিকের নাম। শুধু লেখা আছে ‘আননোন ডগ’। আর জানা আছে, ওই কুকুরটির ডায়ালিসিস করার সুপারিশ করেছিলেন তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজি। হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মীরা বলছেন, কুকুরটি নির্মল মাজির এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার বলেই তাঁরা জানতেন। কিন্তু নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রাজেন পাণ্ডে ওই ‘ভিভিআইপি’ কুকুরটি নিয়ে তাঁর সতীর্থদের কাছে যা বলেছেন, তাতেই রহস্য দানা বেঁধেছে।
কী বলেছিলেন রাজেন পাণ্ডে?
এসএসকেএম সূত্রে খবর, নেফ্রোলজির প্রধান চিকিৎসক রাজেন পাণ্ডে তাঁর সতীর্থদের বলেছেন, ‘‘যত যা-ই হোক, এসএসকেএমের মতো হাসপাতালে একটা কুকুরের ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা করতে বলার জন্য যে সাহস দরকার হয়, তা এমনি এমনি আসে না। নির্মল মাজি ওঁর কোনও আত্মীয়ের জন্য এটা করবেন, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। অনুরোধটা অবশ্যই এমন জায়গা থেকে এসেছে, তার মালিক এমনই প্রভাবশালী কেউ, যেখানে না
বলার মতো দুঃসাহস কেউই দেখাতে পারে না।’’
ওই কুকুরটির মালিক কে, তা নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে। অনেকেরই প্রশ্ন, যেখানে হাসপাতাল চত্বরে অজ্ঞাতপরিচয়, মুমূর্ষু মানুষ পড়ে থাকলেও নিয়মের দোহাই দিয়ে চিকিৎসা হয় না, অভিভাবক হিসেবে কে সই করবেন তা স্থির না-হওয়ায় জীবনদায়ী অস্ত্রোপচার পর্যন্ত বাতিল করে দেওয়া হয়, সেখানে একটি ‘আননোন ডগ’ এত মনোযোগ কেড়ে নেয় কীসের জোরে? কুকুরটি যদি নির্মল মাজির আত্মীয়েরই হবে, তা হলে সেই আত্মীয়ের নামই বা নেই কেন? কেন বেওয়ারিশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটিকে? তা হলে কি রাজেন পাণ্ডে তাঁর সতীর্থদের যা বলেছেন সেটাই ঠিক?
স্বাস্থ্য ভবনেরও বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। সেখানকার একাধিক কর্তার বক্তব্য, ‘‘কুকুরের ডায়ালিসিসের প্রসঙ্গ সামনে এসেছে বলে প্রদীপবাবুকে সরতে হল, তা নয়। এই তালেগোলে ডায়ালিসিসটা যে হল না, প্রদীপবাবুর ওপরে মূল রোষের কারণ সেটাই। ডায়ালিসিস না পেয়ে কুকুরটার অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। আর তাতেই প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের ক্ষোভ বেড়েছে প্রদীপ মিত্রকে নিয়ে।’’
শুধু তাই নয়, যেখানে পান থেকে চুন খসলে তদন্ত শুরু হয়ে হয়, সেখানে কুকুর-কাণ্ডের জের বিধানসভা এমনকী দিল্লির মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-য় পৌঁছে গেলেও কেন কোনও তদন্ত কমিটি হল না— প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। এক স্বাস্থ্য-কর্তার মন্তব্য, ‘‘কুকুরের পরিচয় যাতে প্রকাশ না পায়, তার জন্যই বোধ হয় তদন্ত চাপা দেওয়া হল। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরোতে পারে তো!’’ কেন তদন্ত হচ্ছে না? গত কয়েক দিন ধরে একই প্রশ্ন করা হয়েছে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনিও একই কথা বলছেন, ‘‘এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেব না। তদন্ত হওয়ার হলে হবে। কবে হবে সেটা আমরা ঠিক করব।’’ কিন্তু এ দিন আর তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
কুকুর-কাণ্ডে নির্মল মাজি জড়িয়ে গেলেন কী ভাবে? এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, ‘‘মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই একটি কুকুরের শারীরিক সমস্যা নিয়ে নির্মলবাবু খুব চিন্তিত ছিলেন। একাধিক দিন হাসপাতালের এসে ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। তার পর কাউকে ফোন করে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সব রিপোর্ট করতেন। এক দিন কুকুরটির অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় তাকে ইমার্জেন্সি-তে আনার কথাও বলেছিলেন নির্মলবাবু। তার পরে আসে এই ডায়ালিসিসের প্রসঙ্গ।’’
কী বলছেন নির্মল মাজি?
তিনি বলেছেন, ‘‘কুকুরটা আমার এক আত্মীয়ের।’’
আত্মীয়টা কে?
নির্মল বলেন, ‘‘কোন আত্মীয় সেটা বড় কথা নয়!’’
এর পরে হঠাৎই নির্মলবাবু বলেন, ‘‘কুকুরটার জন্য দিদি খুব কষ্ট পেয়েছেন। লোকে নিজের প্রিয় মানুষের জন্যও এত কষ্ট পায় না! ডায়ালিসিস করাতে পারলে কুকুরটাকে বাঁচানো যেত। যা-ই হোক, এই ঘটনায় আমার ভাবমূর্তিতে যতই কালি লাগুক, দুটো উপকার হয়েছে। পশু হাসপাতালে ডায়ালিসিস যন্ত্র কেনার ব্যবস্থা পাকা। আর পশুদের জন্য একটা শ্মশানও তৈরি হচ্ছে।’’
তা হলে কি কুকুরটা বেঁচে নেই?
নির্মল বলেন, ‘‘এই প্রশ্নের কোনও জবাব আমি দেব না!’’
হঠাৎ করে দিদি-র নাম কেন টানলেন নির্মল? তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা এরও কোনও জবাব দেননি।
সংবাদমাধ্যমের কাছে রাজেনবাবু অবশ্য দাবি করেছিলেন, কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর কোনও নির্দেশ তিনি দেননি। কিন্তু তাঁরই বিভাগে ডায়ালিসিস রোগীদের রেজিস্টারে ‘আননোন ডগ’-এর ডায়ালিসিস করানোর পরিকল্পনার কথা লেখা রয়েছে। এমন কী কোন যন্ত্রে
তা হবে, সেটাও লেখা রয়েছে। বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া যে সেটা অসম্ভব, তা জানিয়েছেন বিভাগের চিকিৎসকেরা।
এ সব শুনে মুখে কুলুপ এঁটেছেন রাজেনবাবু। কোনও প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যায়নি তাঁর কাছে।
নেফ্রোলজির চিকিৎসকেরা অবশ্য বলছেন, ‘‘যেখান থেকে কুকুরের ডায়ালিসিসের অনুরোধটা এসেছিল, তা রাজেন পাণ্ডে বিলক্ষণ জানতেন। এ-ও জানতেন যে কুকুরের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। তাই সব কাগজপত্রে ‘আননোন ডগ’
লেখা হয়েছে। আর ওই ‘আননোন’ শব্দটাই কুকুরটিকে ‘ভিভিআইপি’ বানিয়ে দিয়েছে।’’