সহপাঠী তিন ছাত্রের ইভটিজিংয়ে নাজেহাল হয়ে উঠেছে কলেজের এক ছাত্রী। এমনই অভিযোগ কানে আসতেই সব কিছু খতিয়ে দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া তিন ছাত্রকে সাসপেন্ড করল কলেজ। ছাত্রীটির পাশে দাঁড়িয়ে কলেজের অধ্যক্ষ তাঁকে থানায় অভিযোগ দায়ের করার সাহস জোগালেন। সেই অভিযোগে গ্রেফতার হল তিন অভিযুক্ত ছাত্র। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ছাত্রদের বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেওয়া, হোয়াটস অ্যাপে কুরুচিকর মেসেজ পাঠানো-সহ বেশ কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করা হয়েছে।
কী ঘটেছিল ওই ছাত্রীর সঙ্গে? কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাঁকুড়া শহরের উপকণ্ঠে পোয়াবাগানের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেকানিক্যাল বিভাগের তৃতীয়বর্ষের ওই ছাত্রীকে তাঁরই তিন সহপাঠী কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্ত্যক্ত করছিল বলে অভিযোগ। হস্টেল থেকে বের হলেই তাঁকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করত। অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও ছোড়া হতো বলে অভিযোগ। এমনকী হোয়াটসঅ্যাপেও তাঁকে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয় বলে ছাত্রীটি পুলিশের কাছে দাবি করেছেন। সমস্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্ণেন্দু অধূর্যের কাছে সব কথা খুলে বলতে বাধ্য হন ওই ছাত্রী।
অভিযোগের সত্যতা বিচার করে অধ্যক্ষ ওই ছাত্রীকে থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দেন। কলেজ থেকেও ওই তিনজনকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বাঁকুড়া মহিলা থানায় ওই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী। বুধবার ঘটনার তদন্তে ওই কলেজে যান মহিলা থানার ওসি রমারাণি হাজরা, সাব-ইন্সপেক্টর মৌমিতা সমাদ্দার-সহ মহিলা থানার পুলিশ কর্মীরা। অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে কলেজে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাঁরা গ্রেফতার করেন। কলেজ কর্তৃপক্ষও এ দিন তাদের সাসপেন্ড করে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ছাত্রদের মধ্যে দু’জন বিহারের ও একজন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা।
ওই ছাত্রীর কথায়, “কলেজে, হস্টেলে সর্বত্রই কিছু দিন ধরে আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল ওই তিনজন। হোয়াটসঅ্যাপেও নোংরা কথা লিখত। এই সব অবাঞ্ছিত ঘটনায় আমার পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছিল। তাই অধ্যক্ষকে সব জানাই।” পোয়াবাগান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “কলেজে ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। তাই ঘটনাটি শোনার পরেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কথাও ঠিক করি। ছাত্রীটিকে অভিযোগ জানাতে বলি। পুলিশ ওদের গ্রেফতার করার পরেই সাসপেন্ড করা হয়।’’ তিনি জানান, ছাত্রীটি সাহস করে তাঁদের সব জানানোর ফলেই এই পদক্ষেপ করা সহজ হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমারও বলেন, “যে ভাবে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীটি এগিয়ে এসেছেন, তাতে তদন্তে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।’’
এই ঘটনায় অভিযোগ জানানোর মতো সাহসী ভূমিকা নেওয়ায় ছাত্রীর প্রশংসা করছেন অনেকেই। তাঁদের মতে, আকছার রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে কিংবা স্কুল-কলেজে ইভি়টিজিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে মেয়েদের। কিন্তু পুলিশকে জানালে পাছে অভিযুক্তেরা পরে সমস্যায় ফেলে দেয়, সেই ভয়ে অনেকেই থানা পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার সাহস পান না। এখানেই ওই তরুণী ব্যতিক্রম।
ব্যতিক্রম কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও। বিষয়টিকে খাটো করে দেখতে নারাজ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত জেলার অনেকেই। তাঁদের মতে, বেসরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ সব সময়েই ছাত্র ধরে রাখতে তৎপর। তাই দুষ্কর্ম করেও অনেক পড়ুয়া পার পেয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সে দিক দিয়ে এ দিন পোয়াবাগানের কলেজ কর্ত়ৃপক্ষ যা করল, তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত বলে মানছেন অনেকে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের মেম্বার তথা বাঁকুড়া সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্ত বলেন, “কমবেশি সব কলেজের ছাত্রীদেরই এই সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু পোয়াবাগান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই ছাত্রীর পাশে যে ভাবে দাঁড়িয়েছেন, তা সত্যিই ব্যতিক্রমী। অন্যান্য কলেজগুলিরও এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে।”
তবে অধ্যক্ষ এই ঘটনায় পাশে পেয়েছেন সহকর্মীদেরও। তাঁর এই ভূমিকা ইতিবাচক বলে মনে করছেন অন্যান্য শিক্ষকেরা। কলেজের ডিন অলোক রায় ও উওমেন সেলের সদস্য সুরেকা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কলেজের অধ্যক্ষের এই কড়া পদক্ষেপে আমরা খুশি। ছাত্রেরা জেনে গেল, এই কলেজে নিয়ম ভাঙলে পার পাওয়া যাবে না।”
কয়েকজন সহপাঠীর আচরণে কষ্ট পেলেও পাশে সমগ্র কলেজকে পেয়ে আপ্লুত ভিন্রাজ্যের বাসিন্দা ওই ছাত্রীও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘কলেজ কর্তৃপক্ষ যে ভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি কৃতজ্ঞ।”