জয়ের উচ্ছ্বাস। বনগাঁয় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
ঘরে-বাইরে প্রবল চাপ। সারদা-কাণ্ডে এক মন্ত্রী সদস্য জেলে। এক সাংসদ জামিনে মুক্তি পেয়েই দল ছেড়েছেন। আর এক মন্ত্রী দল ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন বিজেপি শিবিরে। দলে প্রতিদিন মাথা তুলছে বিক্ষুব্ধ স্বর। এক সময়ের বিশ্বস্ততম সেনাপতির সঙ্গে বিচ্ছেদ প্রায় ঘনিয়ে উঠেছে।
এমন তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জোড়া উপনির্বাচনে জয় পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন এই জয় ঐতিহাসিক, ‘মিরাকল’। আর এই মন্তব্যই বুঝিয়ে দিল কতটা বিপাকে রয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
অলৌকিকই বটে! দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অপশাসনের দায়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি থেকে শিল্পে হাহাকার এত সব সত্ত্বেও বনগাঁ লোকসভা এবং কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এত বড় ব্যবধানে অনায়াস জয় আসবে, এমনটা তৃণমূলের অতি বড় সমর্থকও ভাবেননি। এটা ঠিক যে দুই কেন্দ্রই শাসক দলের দুর্গ। কিন্তু তাতে যে টোল পড়ল না, তার দু’রকম ব্যাখ্যা মিলছে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে।
বনগাঁ কেন্দ্রে জয়ের ব্যবধান ৮ মাস আগে যা ছিল তা থেকে ৬৫ হাজার বাড়িয়ে ২ লক্ষ ১১ হাজার ৭৯১-এ নিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। কৃষ্ণগঞ্জে ব্যবধান ২০১১ সালে ছিল প্রায় ২১ হাজার। সেটা এ বার হয়েছে ৩৭,৬২০। যা ২০১৪-র লোকসভা ভোটের ব্যবধানের থেকে হাজার তিনেক বেশি। এই ফল দেখিয়ে তৃণমূল শিবির বলছে, যতই অভিযোগ উঠুক না কেন, গ্রাম এবং মফস্সলে মমতার জনপ্রিয়তা এখনও অটুট। শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মদন মিত্র জেলে থাকতে পারেন। সৃঞ্জয় বসু দল ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু উপনির্বাচনে বোঝা গেল, এঁদের দিয়ে মানুষ তৃণমূলকে বিচার করছেন না। তাঁরা ভোট দিচ্ছেন মমতার নামে!”
এর পাল্টা হিসেবে বলা হচ্ছে, আপাতত ভোটবাক্সে যা কিছু ওলোটপালট তা সবই বিরোধী শিবিরে। বামেদের পিছনে ঠেলে দ্রুত উঠে আসছে বিজেপি। বনগাঁয় গত লোকসভা নির্বাচনে বামেদের প্রাপ্ত প্রায় ৩২% ভোট এ বার কমে দাঁড়িয়েছে ২৭%! সেই জায়গায় বিজেপি-র ভোট ১৯% থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫%! কৃষ্ণগঞ্জে বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন আরও প্রবল। সেখানে ৮ মাস আগের ৩১% থেকে তারা নেমে এসেছে ১৯%-এ!আর সেই সুযোগে বিজেপি ১৫% থেকে উঠে এসেছে ২৯%-এ। মাত্র ৮ মাসের মধ্যে ১৪% ভোটবৃদ্ধি ঘটেছে তাদের! কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বিজেপির সংগঠন এখনও তেমন দানা বাঁধেনি। স্থানীয় বিষয়কে হাতিয়ার করে মাঠে নামার ব্যাপারেও খামতি রয়েছে বিজেপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। ফলে শাসক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে ভোটবাক্স পর্যন্ত নিয়ে যেতে তারা ব্যর্থ। সেই সুবিধা কাজে লাগিয়েই তরে গিয়েছে তৃণমূল।
তবে কারণ যা-ই হোক, জোড়া জয়ের পরে স্বাভাবিক ভাবেই উল্লাসে ফেটে পড়েছে তৃণমূল শিবির। খোদ মমতা বলেছেন, “মা-মাটি-মানুষের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁরা আবার আমাদের প্রতি ভালবাসা ও ভরসা রেখেছেন। ঐতিহাসিক জয়! একটা উপনির্বাচনে এত বড় ব্যবধান আগে কখনও হয়নি! সব চক্রান্ত ও অপপ্রচারকে মানুষ ব্যর্থ করেছে!”
আর বিজেপি কবুল করছে, সরকার-বিরোধী ক্ষোভকে তারা ভোটের বাক্স পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি। উপনির্বাচন থেকেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেও দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ মেনে নিয়েছেন, এ রাজ্যে তাঁদের ভোট বাড়লেও তৃণমূলকে হারাতে আরও অনেক পথ যাওয়া বাকি!
তবে বিজেপির পক্ষে স্বস্তির বড় কারণ এটাই যে, বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। বনগাঁয় সিপিএমের ভোট ৮ মাসেই কমছে ৭৬,৩৯৮। সব মিলিয়ে তারা দ্বিতীয় স্থানে শেষ করলেও এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩টিতে তারা বিজেপির পিছনে। আর কৃষ্ণগঞ্জে তো বামেদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ২০১১-র তুলনায় এখানে তাদের ভোট কমেছে প্রায় ৩৮ হাজার। গত বছরের লোকসভা ভোটের নিরিখে ২৩ হাজারেরও বেশি। সব মিলিয়ে এ দিন মোট যে ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটগণনা হল তাতে সিপিএম এবং বিজেপি দ্বিতীয় হয়েছে চারটি করে কেন্দ্রে। এই দিক থেকে দেখলে দুই বিরোধী দল তুল্যমূল্য জায়গায় থাকলেও শতাংশের হিসেবে কিন্তু বিজেপি-র রেখচিত্রই ঊর্ধ্বগামী।
আর এই আবহে তৃণমূলের সাফল্যের আড়ালে তাদের জন্য প্রছন্ন অস্বস্তির আরও একটা কারণ দেখছেন কেউ কেউ। আপাতদৃষ্টিতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকা বিরোধী পক্ষের সঙ্গে তৃণমূলের ফারাক অনেকটাই। কিন্তু বনগাঁ এবং কৃষ্ণগঞ্জ, দুই কেন্দ্রেই সিপিএম এবং বিজেপি-র ভোট যোগ করলে তৃণমূলের জয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়! দুই কেন্দ্রেই সিপিএম এবং বিজেপির মিলিত ভোট তৃণমূলের চেয়ে বেশি! সেই তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করে কেউ কেউ বলছেন, বিরোধী ভোট বিভাজনই মমতার সাফল্যের আসল মন্ত্র! কিন্তু বিজেপি যদি ক্রমে বামেদের জায়গা দখল করে নিতে পারে তা হলে সেই সাফল্যের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তৃণমূলের শিবির থেকে যার পাল্টা বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে এমন কিছু না কিছু অঙ্ক সব সময়ই থাকবে। অতীতে বামফ্রন্টও বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়ে বহু বার জিতেছে।
বিরোধী ভোট ভাগাভাগি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তৃণমূল স্বাভাবিক ভাবেই এখন এই ফলের ইতিবাচক দিকে নজর দিতে চাইছে। আর মাসদুয়েকের মধ্যে পুরভোট আসন্ন। এই ফল যেমন পুরভোটের আগে বিরোধীদের মনোবলে প্রভাব ফেলবে, তেমনই বাড়তি উৎসাহ জোগাবে শাসক দলকে। তৃণমূলের পক্ষে আরও বেশি স্বস্তির কারণ, দলের মধ্যে আসন্ন ভাঙনের যে ছবি ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছিল, তাতে আপাতত যবনিকা পড়তে পারে। তৃণমূল সত্যিই ‘ডুবন্ত জাহাজ’ কি না, এই ফলাফলের পরে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বিক্ষুব্ধদের। তৃণমূলের এক সাংসদের কথায়, “ক্ষোভ-বিক্ষোভ দলের মধ্যে আছে ঠিকই। কিন্তু এখন সকলকেই ভাবতে হবে, বিকল্প কোথায়? যাঁরা বিজেপি-কে নিয়ে লাফালাফি করছিলেন, তাঁরা এ বার জবাব পেয়ে গিয়েছেন আশা করি!” তৃণমূল শিবির সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, বনগাঁ এবং কৃষ্ণগঞ্জে সংখ্যালঘু ভোট থাকলেও খুব বেশি ছিল না। কাজেই শুধু সংখ্যালঘু-তাসে তৃণমূল বাজিমাত করেছে, এমন বলারও জায়গা নেই।
কৃষ্ণগঞ্জে জয়ী সত্যজিৎ বিশ্বাস। সোমবার রানাঘাটে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
উপনির্বাচনে জয়ের খবর নিয়েই এ দিন পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক কাজে পৌঁছেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখানে তাঁর মন্তব্য, প্রবল চাপের মুখে এই জয় তাঁকে আরও ১০ বছর ‘মানুষের জন্য কাজ’ করার প্রেরণা দিল। একই সঙ্গে তাঁর বার্তা, “যত জিতব, তত আরও সাবমিসিভ হব। যত জিতব, তত আরও বোল্ড হব! আরও বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়াব।” যা শুনে বিরোধীরা বলছেন, দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবালের কায়দায় অহঙ্কার থেকে দূরে থাকার বার্তা মমতা দিতে চেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের এ সব মনে থাকবে তো?
জয়ের আনন্দে উদ্দীপ্ত তৃণমূল নেতারা অবশ্য এ দিন সব ধরনের ‘বিরোধী কণ্ঠ’কে কটাক্ষই করেছেন। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, “এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম কুৎসা করেছিল। যারা শাপলা ফোটাতেই পারে না, তারা ফোটাবে পদ্ম! যত কুৎসা-অপপ্রচার করবেন, তত গ্রামের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবেন।”
গ্রামাঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটানোর সুফলই মমতা পেয়েছেন বলে পার্থবাবুর দাবি। আর গেরুয়া বাহিনীকেই প্রধান প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে তাদের প্রতি মহাসচিবের কটাক্ষ, “২০১৬ সালে হবে ভাগ বিজেপি ভাগ!”