পুরভোট মিটেছে অশান্তি, বেনিয়ম এবং বিস্তর কারচুপির অভিযোগের মধ্যে দিয়ে। এ বার ফল ঘোষণার পালা। কলকাতা-সহ রাজ্যের ৯২টি পুরসভার ভোটের ফল জানা যাবে আজ, মঙ্গলবার। সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে গণনা, দুপুরেই মধ্যেই সব ওয়ার্ডের চূড়ান্ত ফল পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। পুরভোটের লড়াইয়ে কে জিতল, সেই কৌতূহল ছাপিয়ে এ বার অবশ্য রাজ্য জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য একটি প্রশ্ন। যে ভোট ঘিরে এত অশান্তি, ফল ঘোষণার পরে কি সব শান্তিপূর্ণ হয়ে যাবে? বিরোধীদের আশঙ্কা, যেখানেই তাদের পক্ষে ইতিবাচক ফল হবে, সেখানে আবার নতুন করে আক্রমণের মুখে পড়তে হতে পারে। আর শাসক দলের অন্দরে চিন্তা, পুরবোর্ড গঠন নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে গোষ্ঠী-লড়াই আজ থেকেই না শুরু হয়ে যায়!
দুই পর্বে ভোটের দিনে শান্তিরক্ষার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোনও আশ্বাসই কাজে আসেনি। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ উঠেছে ভূরি ভূরি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় অবশ্য এ বারও জানিয়েছেন, প্রতি গণনা কেন্দ্রে ক্লোজ্ড সার্কিট টিভি বসাতে বলা হয়েছে। গণনা কেন্দ্রে দ্বিস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। দায়িত্বে সশস্ত্র পুলিশ। সুশান্তবাবু জানিয়েছেন, গণনা কেন্দ্রে যাতে সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থী, এজেন্ট ও গণনা-কর্মী নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এত আশ্বাস সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে গণনা কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে বিরোধীদের আশঙ্কা করার যে যথেষ্ট অবকাশ আছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে সোমবারই। শিয়ালদহে টাকী গভর্মেন্ট স্পনসর্ড মাল্টিপার্পাস বয়েজ স্কুলে কলকাতা পুরসভার ৩ নম্বর বরো-র ভোটগণনার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে এ দিন প্রার্থীর এজেন্ট পরিচয় দিয়ে গণনাকেন্দ্রে ঢোকার ৫টি পরিচয়পত্র নিয়ে বেরিয়ে যান এক ব্যক্তি! পুলিশ জানায়, সোমা দে নামে এক প্রার্থীর এজেন্ট বলে দাবি করে পরিচয়পত্র তোলা হয়েছিল। পরে জানা যায়, ওই নামে কোনও প্রার্থীই নেই! পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে। স্বভাবতই ভোট গণনাতেও বিপুল কারচুপি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে বিরোধীরা। গণনার আগেই বেলঘরিয়া এবং ব্যারাকপুরে সিপিএম কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগ এসেছে। অশান্তির আশঙ্কায় বিভিন্ন শহরে বহু স্কুল আজ ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেছেন, ‘‘শাসক দল পঞ্চায়েতে কী ভাবে ভোট গণনায় জালিয়াতি করেছিল, সে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। তাই দলমত নির্বিশেষে সকলকে সতর্ক থাকার জন্য আবেদন করছি। যাতে মানুষ যেটুকু ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, তা যেন প্রতিফলিত হয়।’’ তাঁর মতে, ‘‘ঠিক ভাবে গণনা হলে অনেক কারচুপি ধরা পড়বে। কারণ, বেশ কিছু জায়গায় মোট ভোটারের থেকেও বেশি ভোট পড়েছে!’’ গণনা কেন্দ্রগুলিকে সুরক্ষিত করার জন্য এ দিন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। সূর্যবাবুর অভিযোগ, বিগত বিধানসভা বা লোকসভা ভোটের নিরিখে যেখানে বামেরা এগিয়ে ছিল, সেখানে ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য শাসক দল এ বার ভোটের দিন চেষ্টা চালিয়েছিল। গণনাতেও আবার একই চেষ্টা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে গণনা কেন্দ্রে যাতে বাম কর্মীরা জমি না ছাড়েন, সেই আবেদন জানিয়ে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘কারচুপির চেষ্টা হলে প্রতিরোধ হবে। গণনা কেন্দ্রের বাইরেও আইন মেনে লোকজন থাকবে।’’
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে আবেদন জানিয়েছেন, কোনও প্ররোচনায় পা না দিতে। ফল ঘোষণার পরে বিজয় উৎসব না করার নির্দেশও জারি হয়েছে। কিন্তু শাসক দলের অন্দরেই এখন সব চেয়ে বড় আশঙ্কা, সম্ভাব্য জয়ের পরে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নিয়ে। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘ভোটে টিকিট না পেয়ে অনেকে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ফল ঘোষণার পরে নানা জনের নানা চাহিদা থেকে আবার কী পরিস্থিতি হবে, বলা মুশকিল!’’
যে ভাবে ‘গা-জোয়ারি’র ভোট হয়েছে, তাতে ফলাফল থেকে বিশেষ কিছু আশা করছে না বিরোধীরা। বামেদের অন্য রকম প্রত্যাশ্যা শিলিগুড়ি ঘিরেই। বাম নেতৃত্বের মতে, উত্তরবঙ্গেই তুলনায় শাসক দলের জবরদস্তির বেশি মোকাবিলা করা গিয়েছে। সূর্যবাবু এ দিন বলেন, ‘‘শাসক দল মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বলেই তারা এ ভাবে আক্রমণ করছে। যেখানে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন, সেখানে যিনিই হারুন বা জিতুন, কিছু বলার নেই। যিনি জিতবেন, তাঁকে অভিনন্দন জানাই। কারণ, সেখানে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।’’ কংগ্রেসের আশা মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গের কিছু পুরসভা, দক্ষিণবঙ্গে খড়গপুর ও কাটোয়া নিয়ে। বিজেপি-র রাহুল সিংহেরা আলাদা করে কোনও জায়গা নিয়ে বাজি ধরছেন না। তাঁরা বলেই দিয়েছেন, ‘‘এই ভোট তো প্রহসন!’’ আর তৃণমূলের নজর কত দূর নিরঙ্কুশ সাফল্য পাওয়া গেল, সেই দিকেই!