ভোটের দিন এবি কমিউনিটি হলের সামনে।
গত ৩ অক্টোবর ভোটের দিন সকাল থেকে বিধাননগর পুর-এলাকা জুড়ে বহিরাগত দুর্বৃত্তদের দাপাদাপি দেখেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সৌজন্যে গোটা রাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন সেই দৃশ্য। নিউটাউন থেকে বাগুইআটি, রাজারহাট থেকে বিধাননগর সর্বত্র কোথাও বোমা হাতে, কোথাও বা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে শাসক দলের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরা। আসানসোলে গুলি চলেছে। বালিতেও বাইরের লোক এসে ভোট দিয়ে গিয়েছে অবাধে। স্থানীয় মানুষ বহু ক্ষেত্রে বুথে ঢুকতেই পারেননি।
অথচ বৃহস্পতিবার বিধাননগর পুরসভার ৯টি এবং আসানসোলের ২টি বুথে পুর্ননির্বাচনের ঘোষণা করার সময়ে সেই সব ঘটনার কথা এড়িয়ে গেলেন রাজ্যের অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়েছে কি না সেটাই আমাদের মূল বিবেচ্য ছিল। যেখানে যেখানে সেটা হয়েছে, সেখানেই আমরা পুনরায় ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ আজ, শুক্রবার ওই ১১টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে। ফল প্রকাশ হবে আগামিকাল, শনিবার।
বুথের বাইরে হিংসা, মারধরের ঘটনাগুলিকে কেন পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হল না? ওই সব ঘটনা কি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অন্তরায় নয়? আলাপনবাবু বলেন, ‘‘বেশ কিছু জায়গায় রাস্তায় গোলমাল হয়েছে। আমরা জেলা পুলিশ, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাঁরা একমত হয়েছেন যে, গণ্ডগোল হলেও সব জায়গায় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। গোদা বাংলায় বলতে গেলে, যে সব জায়গায় বুথ দখল হয়েছে, সেখানেই পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে।’’
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে বুথে আসতে পারেন তা নিশ্চিত করা কি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? সেই জন্যই তো ভোটের আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতীদের ধরপাকড় করে কমিশনে রিপোর্ট পাঠায় পুলিশ। কত অস্ত্র বা নেশার দ্রব্য আটক করা হল, তারও বিস্তারিত বিবরণ থাকে পুলিশ রিপোর্টে। বিরোধীদের প্রশ্ন, যদি ভোটাররা প্রাণের ভয়ে বাড়ির বাইরে না বেরোন, বেরিয়েও যদি সন্ত্রাসের কারণে বুথ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারেন, তা কি কমিশন দেখবে না?
এ নিয়ে এ দিন রাজ্যপালের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে বাম প্রতিনিধি দল। সিপিএম নেতা রবীন দেব পরে বলেন, ‘‘পুরো ভোট প্রক্রিয়া শান্তিতে করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। ভোটের সময় পুলিশ তারই নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে বুথের বাইরে কোনও গোলমাল হলে পুলিশকে সক্রিয় হতে বলা কমিশনের কাজ। এক জন আইএএস অফিসার কী করে এ ধরনের কথা বলেন, তার কৈফিয়ৎ তলব করার জন্য রাজ্যপালকে আমরা অনুরোধ করেছি।’’ বিরোধী নেতাদের আরও বক্তব্য, ‘‘এমন একটা কিছু যে হবে তা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসানোর সময়েই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। রাজ্য সরকারের কর্মী এ ছাড়া আর কিছু যে করবেন না, তা পরিষ্কার। সেই কারণেই আমরা তাঁর নিয়োগের বিরোধিতা করেছি।’’
নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে আলাপনের নিয়োগ নিয়ে সরব হয়েছেন আইনজ্ঞেরাও। এ নিয়ে হাইকোর্টে এ দিন মামলা হয়েছে। নবান্ন অবশ্য বামফ্রন্ট আমলে তৈরি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইনের তিন নম্বর ধারার দুই নম্বর উপধারার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে আলাপনবাবুর নিয়োগ বৈধ বলেই দাবি করে আসছে। আইনজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘কোনও আইন যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে তা প্রয়োগ করা হবে কেন?’’ এক আইনজীবীর মন্তব্য, ‘‘ইন্দিরা গাঁধী ১৯৭৫ সালে আইন মেনেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু নৈতিক ভাবে তিনি ঠিক কাজ করেননি। ঠিক এ ক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রুটিপূর্ণ একটি আইনের সাহায্য নিয়ে নিজের রাজনৈতিক ইচ্ছা চরিতার্থ করেছেন।’’
শুক্রবারের পুনর্নির্বাচনও বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী দলগুলি। তাদের দাবি, গত গোটা ভোটটাই বাতিল করতে হবে। অন্য দিকে, তৃণমূলের তরফে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা বলেছিলাম, কোনও গণ্ডগোল থাকলে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হোক। কিন্তু ভোট প্রক্রিয়া যেন বন্ধ করা না হয়। কমিশন শেষ পর্যন্ত যে ভোট গণনার দিন ঘোষণা করেছে, তাতে আমরা খুশি। আমরা অবস্থানও তুলে নিচ্ছি।’’কিন্তু রাজ্য সরকার বিকল্প কী করতে পারত? এক আইনজীবীর মন্তব্য, ‘‘নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করার জন্য রাজ্যপাল ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কোনও আমলাকে স্থায়ী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা যেত। রাজ্যে এই পদের যোগ্য অবসরপ্রাপ্ত কোনও আইএএস অফিসার কি মুখ্যমন্ত্রী খুঁজে পেলেন না, নাকি সেই চেষ্টাই তিনি করেননি। আইনের সুযোগে নিয়ে আস্থাভাজন এক কর্মরত আমলাকে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করলেন তিনি।’’
তৃণমূল অবস্থান তুলে নিলে কী হবে, বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনের রাস্তার দখল নেয় সিপিএম। এ দিন রাত নটা নাগাদ আলাপনবাবু দফতর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময়ে সিপিএম সমর্থকেরা তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। স্লোগান চলে। পুলিশ গাড়িটি কোনও মতে বের করে দেয়।
কী ভাবে পুনর্নির্বাচনের বুথগুলি ঠিক করেছে কমিশন?
এ ক্ষেত্রে ভোটের দিনের ভিডিও ফুটেজ দেখা জরুরি নয় বলে বুধবারই মত দিয়েছিলেন আলাপনবাবু। বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নিয়মাবলিতে ছবি দেখে পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও বিধিবদ্ধ নির্দেশ নেই। এ ব্যাপারে সব রকম দলিল-দস্তাবেজ এবং অন্যান্য তথ্য খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভোট-পরবর্তী মামলার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে ভেবেই সম্ভবত ভিডিও ছবি তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এমনটাই ছিল তাঁর মত। এর পরেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিরোধীরা বলতে থাকেন, ভোট চলাকালীন বুথের ভিতরে গোলমাল বা সন্ত্রাস যাচাইয়ে যাতে মানুষের ভুল (হিউম্যান এরর) প্রাধান্য না পায় তার জন্যই ভিডিও ছবি তোলা আবশ্যিক করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। ছবি যে হেতু মিথ্যে বলে না, তাই এখন পুলিশি তদন্ত থেকে শুরু করে জেরা, জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকী বহু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতেও ভিডিও ফটোগ্রাফির দ্বারস্থ হন অফিসারেরা। পুর-ভোটে ব্যবহৃত সেই যন্ত্রকেই কী ভাবে অস্বীকার করছেন আলাপনবাবু, প্রশ্ন ছিল বিরোধীদের।
সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন...
এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে আলাপনবাবু সাংবাদিক বৈঠকে জানান, প্রিসাইডিং অফিসার, পর্যবেক্ষক ও বিশেষ পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টের পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজও দেখা হয়েছে। কিন্তু যে কমিশনার বুধবার বলেছিলেন ভোটের দিনের প্রায় দু’হাজার ঘণ্টার ফুটেজ দেখতে সময় লাগবে, তিনিই কী করে বৃহস্পতিবার বললেন, সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা ভোটের দিনের ভিডিও ফুটেজ দেখে রিপোর্টে মতামত দিয়েছেন। যা শুনে বিরোধীদের বক্তব্য, এত কম সময়ে সমস্ত ভিডিও ফুটেজ আদৌ খতিয়ে দেখা হয়েছে কি না, সে সংশয় রয়েই গেল। তার ওপর যে পর্যবেক্ষকরা ভোটের দিন ভোটদাতাদের কাতর ডাক উপেক্ষা করে গাড়ির কাচ তুলে চলে যান, তাঁরা কতটা নিরপেক্ষ ভাবে ভিডিও ফুটেজ দেখবেন, সেই সন্দেহও থাকছে। আলাপনবাবু এ দিন বলেন, ‘‘কমিশন ওয়েব-কাস্টিং করে। সেটি বহু ঘণ্টার, এত কম সময়ে তা দেখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, জেলা প্রশাসন ভিডিওগ্রাফি করে। জেলার আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা ওই ভিডিওগ্রাফির ফুটেজ খতিয়ে দেখেছেন। কমিশনও দু’টি টেলিভিশন চ্যানেলের ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে। তার পরে আমরা যূথবদ্ধ ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
তাতে বুথের বাইরের গোলমাল যে তেমন প্রাধান্য পায়নি তা আলাপনবাবুর কথাতেই পরিষ্কার।