সারদা মামলার পাশাপাশি এ বার জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহৃত অর্থের উৎস সন্ধানেও নামছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে এনআইএ-র সন্দেহ, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও বাংলাদেশ থেকে হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা ভারতে ঢুকেছে। সেই বিষয়টিই খতিয়ে দেখবেন ইডি-র তদন্তকারীরা। তা ছাড়া, ওই জঙ্গিদের মাধ্যমে দেশে জাল টাকা ঢুকেছে বলেও সন্দেহ ইডির।
আজ, সোমবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর (ইডি) চার-পাঁচ জনের একটি দলের বর্ধমান যাওয়ার কথা। প্রাথমিক ভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ইডি নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও ২ অক্টোবর বর্ধমান থানায় হওয়া এফআইআরের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট তৈরি করবে। ওই নথিকে ইডি-র পরিভাষায় ‘এনফোর্সমেন্ট কেস ইনফরমেশন রিপোর্ট’ বলা হয়। ওই রিপোর্ট জমা পড়ার পরেই ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ (পিএমএলএ) অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করবে তারা। খাগড়াগড়ে দুই মহিলা-সহ যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ইডি তাদের জেরা করবে। এনআইএ জেনেছে, খাগড়াগড়ের কুশীলবদের মধ্যে টাকা বিলি করত মঙ্গলকোটের কুলসুনো গ্রামের এক ব্যক্তি। তার খোঁজ চলছে।
কেন্দ্রীয় সংস্থার পাশাপাশি জেহাদিদের সম্পত্তি ও অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে উদ্যোগী হচ্ছে রাজ্য পুলিশের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ-ও (ইবি)। রবিবারই বর্ধমান জেলা পুলিশকে চিঠি দিয়ে ইবি জানিয়েছে, মঙ্গলবার তারা বর্ধমানে যাচ্ছে।
কিন্তু এনআইএ যেখানে তদন্ত চালাচ্ছে, সেখানে রাজ্য পুলিশের একটি সংস্থা কি এই ভাবে খোঁজখবর নিতে পারে? এনআইএ সূত্রে এ দিন জানানো হয়েছে, ইবি অনুসন্ধান করে দেখতেই পারে, কিন্তু তদন্তের এক্তিয়ার তাদের নেই। পিএমএলএ অনুযায়ী তদন্তের অধিকার কেবল ইডি-র আছে। তবে ইবি নিজের মতো করে অনুসন্ধান করলে তাদের কোনও আপত্তি বা অসুবিধে নেই বলে জানিয়েছে এনআইএ।
২ অক্টোবর বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে মেলা রাসায়নিক, বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জামগুলি নজর করেই তদন্তকারীদের সন্দেহ হয়েছিল, এর পিছনে নিয়মিত বিপুল অর্থের জোগান রয়েছে। গোয়েন্দারা পরে জানতে পারেন, দুবাই থেকে বাংলাদেশের কয়েক জন ব্যবসায়ীর হাত হয়ে হাওয়ালার মাধ্যমে এই অর্থ এসে পৌঁছত এ রাজ্যে। জেহাদিদের জন্য নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল বলেও জেনেছিলেন তদন্তকারীরা। সন্দেহভাজন যে সব লোকের নাম খাগড়াগড় কাণ্ডে উঠে আসছে, তাদের সম্পত্তির পরিমাণ দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন গোয়েন্দারা। সম্প্রতি এনআইএ-র তরফে জেলা পুলিশ, সিআইডি, ব্যাঙ্ক-সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে জানানো হয়েছে, তদন্তের পরবর্তী পর্যায়ে ওই সব সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে তথ্য চাওয়া হবে। এনআই কথা বলবে সংশ্লিষ্ট সব পঞ্চায়েত এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের সঙ্গেও। শুধু আরব মুলুক থেকে বাংলাদেশ হয়েই টাকা আসত, নাকি আর কোনও পথে তা পাঠানো হতো তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
এনআইএ জেনেছে, পূর্বস্থলী থেকে হাসেম মোল্লা নামে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই যুবকের নামে ২৫ কাঠা জমি কিনে মঙ্গলকোটের নিগনে আর একটি মাদ্রাসার নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছিল। বাজার দরের থেকে অনেকটাই বেশি দামে, প্রায় আট লক্ষ টাকায় কেনা হয়েছিল সেই জমি। গোয়েন্দাদের অনুমান, নির্মাণে এখনও পর্যন্ত ১২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। পুরো বাড়ি তৈরি করতে আরও অন্তত ২০ লক্ষ টাকা লাগত। এত টাকা কোথা থেকে এসেছিল, সেই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।
এ ছাড়া মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটী গ্রামে ইউসুফ শেখের মাটির বাড়ির পাশে যে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি হচ্ছিল, তা-ও অবাক করেছে গোয়েন্দাদের। দিন কয়েক আগে তল্লাশিতে গিয়ে এনআইএ-র দুই অফিসার আলোচনা করছিলেন, যে পরিবার ১২ বিঘা চাষযোগ্য জমির উপরে নির্ভরশীল, তাদের পক্ষে কী ভাবে এত বড় বাড়ি তৈরি করা সম্ভব! গোয়েন্দাদের খবর অনুযায়ী, ইউসুফ ও তার শাগরেদ বোরহান সম্প্রতি আরও নানা জায়গায় জমি কিনেছিল। তার মধ্যে নিগন মৌজায় একটি তিন কাঠা জমি এবং ভাতার বাসস্টপের কাছে নিত্যানন্দপুর পঞ্চায়েত এলাকায় একটি জমির খোঁজ পেয়েছেন তাঁরা। বোলপুরের মুলুক গ্রামে যে এক বিঘা জমির উপরে নির্মাণকাজ চলছিল, সেটির ব্যাপারেও খোঁজ চলছে। খাগড়াগড়-কাণ্ডে সন্দেহভাজন হবিবুরের ঘনিষ্ঠ ডালিম শেখ তিন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই জমি কিনিয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। সেই তিন জনও এখন ফেরার।
নিগনে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় ইউসুফ ও তার স্ত্রী আয়েষার অ্যাকাউন্ট ছিল। ওই শাখায় ইউসুফ নামের ৪৮টি অ্যাকাউন্ট, আয়েষা নামের ২১টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গিয়েছে। সেগুলির মধ্যে ফেরার দম্পতির অ্যাকাউন্ট কোনগুলি, সেটা গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন। ভাতারের একটি ব্যাঙ্কেও বোরহান ও ইউসুফের অ্যাকাউন্ট ছিল বলে খবর রয়েছে। দিল্লি থেকে এনআইএ-র কর্তারা সরাসরি এই সব ব্যাঙ্কের শাখায় ফোন করে ইদানীং কী কী বড় লেনদেন হয়েছে, তার তালিকা চেয়েছেন।