দেবাঞ্জন দেব ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত তৃণমূল সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সংঘাত এখন প্রকাশ্যে। সেই কারণেই কি করোনার ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডের মতো রাজ্যের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ের তদন্তে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে পাঠানো হচ্ছে? জাল টিকা শিবির নিয়ে ইডি-র তৎপরতাকে ঘিরে এই প্রশ্নটি জোরদার হয়ে উঠেছে। ভুয়ো ভ্যাকসিন শিবিরের বিষয়টি আছে কলকাতা পুলিশের আওতায়। সেই কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে তদন্ত চালাতে চাইছে ইডি। কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে ভ্যাকসিন মামলার নথিপত্র তলব করেছে তারা। পশ্চিমবঙ্গে এর আগে কোনও ঘটনায় কলকাতা বা রাজ্য পুলিশের সঙ্গে ইডি সমান্তরাল তদন্ত করছে, এমন নজির বিশেষ নেই।
এ ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে। ১) রাজ্যের কোনও মামলায় ইডি কি আদৌ এ ভাবে তদন্তে নামতে পারে? ২) রাজ্য তথা কলকাতা পুলিশ যেখানে মামলা চালাচ্ছে, সেখানে এমন সমান্তরাল তদন্তের প্রয়োজন আছে কি? ৩) এর আগে এমন আর্থিক অনিয়ম নিয়ে রাজ্যের পুলিশ অনেক তদন্ত করেছে। তখন ইডি-র তরফে আগ্রহ দেখানো হয়নি কেন?
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সিবিআই তখনই কোনও মামলার তদন্ত শুরু করতে পারে, যখন রাজ্য সরকার সেই মামলা সিবিআইয়ের কাছে পাঠায় অথবা হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়। ইডি-র ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং (পিএমএল) আইন মোতাবেক ইডি দেশের যে-কোনও প্রান্তে যে-কোনও আর্থিক অনিয়মের তদন্ত করতেই পারে। তবে সিবিআই যেমন নিজের থেকেই মামলা রুজু করে তদন্ত চালাতে পারে, ইডি তা পারে না। হয় সিবিআই অথবা রাজ্য পুলিশের দায়ের করা কোনও মামলার উপরে ভিত্তি করে ইডি-কে তদন্তে নামতে হয়। ইডি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে তদন্ত চালাতে পারে না।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ইডি-র কাছে কোনও অভিযোগ এলে তারা তদন্ত করে দু’দফায়। একটি প্রাথমিক তদন্ত এবং পরে সবিস্তার তদন্ত। এই দু’দফা তদন্তের ভিত্তিতে সিবিআই বা রাজ্য পুলিশকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতুন ভাবে মামলা করার জন্য অনুরোধ করতে পারে ইডি। ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডে পুলিশ তদন্ত করছে। সেখানে ইডি সমান্তরাল তদন্ত শুরু করে কী ভাবে?
পুলিশ যে-বিষয়ে তদন্ত করছে, সেই একই বিষয়ে যদি ইডি-র কাছেও অভিযোগ যায়, তা হলে পিএমএলএ আইনের আওতায় ইডি তদন্ত করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের সূত্রটি জানিয়েছে। ওই সূত্রের দাবি, এ-সব ক্ষেত্রে কাউকে দিয়ে অভিযোগ করিয়ে নেওয়ারও রেওয়াজ আছে।
২০১৯ সালে পিএমএলএ আইন সংশোধন করে ইডি-র হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সূত্রে কোনও মামলা ছাড়াই তল্লাশি, নথি আটকের ক্ষমতাও পেয়েছে ইডি।
ইডি-র দাবি, ভুয়ো ভ্যাকসিন মামলার শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। তা ছাড়া প্রশ্ন উঠছে কলকাতা পুলিশের তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে। ঘটনার প্রাথমিক অনুসন্ধানের পরে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই তদন্তকারী সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, ভ্যাকসিন কাণ্ডে কয়েক কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে। প্রতারণা কাণ্ডের মূল চক্রী দেবাঞ্জন দেবের সঙ্গে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগ আছে, এমন তথ্য উঠে এসেছে প্রকাশ্যে। ইতিমধ্যেই কলকাতায় ‘এনফোর্সমেন্ট কেস ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট’ (ইসিইআর) দায়ের করে তদন্তের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বলে জানান তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা। ইডি-কর্তাদের কথায়, ঘটনা শুধু জাল টিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নিজেকে পুরসভার যুগ্ম কমিশনার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা চক্র চালিয়েছে দেবাঞ্জন। সে-ক্ষেত্রে পুরকর্তা-সহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে দেবাঞ্জনের ঘনিষ্ঠতার কথা প্রকাশ্যে এসেছে। জাল ভ্যাকসিন এবং আর্থিক প্রতারণার সেই চক্র কতটা গভীরে ছড়িয়েছে, তা দেখা হবে।
ইডি-কর্তাদের দাবি, ইতিমধ্যেই ওই মামলার তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেবাঞ্জনের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে থাকা প্রভাবশালীদের নামের ফলক ভেঙে ফেলা হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ লোপাটের আশঙ্কা করছেন দেবাঞ্জনের আইনজীবী দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যও। আলিপুর আদালতে তাঁর মক্কেলকে জিজ্ঞাসাবাদের বয়ান এবং বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি অভিযানের সমস্ত কিছু ভিডিয়োগ্রাফি করার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।