মাশরুম হল ভোজ্য ছত্রাক। এটা এমন একটা খাবার, যেটা খাদ্যগুণের নিরিখে নিরামিষের একটু উপরে, আমিষের একটু নীচে। অর্থাৎ মাশরুমের প্রোটিন অন্য নিরামিষ প্রোটিনের চেয়ে উচ্চ মানের, কিন্তু মাংস বা অন্য আমিষ প্রোটিনের তুলনায় সামান্য নিম্ন মানের। কম ক্যালোরি হওয়ায় হৃদরোগীদের খাবার হিসাবে খুবই ভাল। এছাড়া রক্তাল্পতা বা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কিংবা শিশুদের হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধির জন্য মাশরুম খুবই উপকারী। আমাদের দেশে মূলত তিন ধরনের মাশরুম চাষ হয়— বোতাম, পোয়াল, ঝিনুক। এর মধ্যে সহজেই বাড়িতে চাষ করা যায় ঝিনুক মাশরুম। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে ঝিনুক মাশরুম চাষের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। খুব গরমকাল বাদ দিলে প্রায় সারা বছর এই মাশরুম চাষ করা যায়। তবে, সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে এই চাষ করতে পারলে ভাল। শুকিয়ে রেখে দিতে পারবেন সাত থেকে আট মাস পর্যন্ত।
পলিথিনের ব্যাগে মাশরুম চাষ
এই ভাবে মাশরুম চাষ করার জন্য এক বিশেষ ধরনের পলিথিনের ব্যাগ লাগে। পলিথিনের ক্যারিব্যাগের মতোই, তবে দু’মুখ খোলা। তলার মুখটা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে খড় চাপাতে হয় পলিব্যাগের মধ্যে। খড় হবে ধান বা গমের। ২-৩ সেমি আকারে কেটে আগের রাতে ব্যাভিস্টিন গোলা জলে (প্রতি লিটারে এক গ্রাম ব্যাভিস্টিন) ভিজিয়ে রাখতে হবে। ব্যাভিস্টিন খড়ের মধ্যের জীবাণু প্রতিরোধে সাহায্য করে। পরদিন ব্যাভিস্টিন ভেজানো খড় এক ঘণ্টা ধরে সিদ্ধ করতে হবে। এতে খড়গুলি সম্পূর্ণ রূপে জীবাণুমুক্ত হবে।
৫ গ্রাম চুন ও ২ গ্রাম ব্লিচিং পাওডার প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে খড় এক রাত ভিজিয়ে রাখলে দ্বিতীয় দিনে আর সিদ্ধ করার প্রয়োজন হয় না। ভেজা খড় ঝুড়িতে রেখে দিলে অতিরিক্ত জল ঝরে যাবে, ক্লোরিনের গন্ধ উবে যাবে। এর পর পলিথিনের ব্যাগে ৬ ইঞ্চি পুরু করে খড়ের স্তর চাপিয়ে তার উপর প্রয়োজন মতো বীজ ছড়াতে হবে। এই বীজের উপর আবার ৪ ইঞ্চি পুরু করে খড়ের স্তর দেওয়ার পর বীজ ছড়াতে হবে। এই ভাবে কয়েকটি স্তর করার পর শেষে বীজের স্তরের উপর এক ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছাতে হবে।
সাজানো হয়ে গেলে উপরে আবার একটা দড়ি দিয়ে পলিথিনটা বেঁধে দেওয়া হয়। এই ভাবে যে পলিথিনের সিলিন্ডার তৈরি হল, তার চারপাশে ও নীচে কয়েকটি ফুটো করে ছায়াযুক্ত স্থানে কাঠের টেবিল বা ওই জাতীয় কিছুর উপরে রেখে দিলেই হবে। ১৮-১৯ দিনের মাথায় কুঁড়ি ফুটতে শুরু করলে উপরের পলিথিনের আস্তরণটা খুলে দিতে হবে। ততদিনে খড় এঁটে যাবে।
দুই দিনের মধ্যেই ফসল তোলার উপযুক্ত হয়। ফসল তুলে রেখে দিলে কিছু দিন পর আবার মাশরুম বেরোবে। এই সময় ভিতরের খড় শুকিয়ে গেলে মাঝেমধ্যে জল স্প্রে করতে হবে। নিয়মিত জল দিলে ১০-১২ দিন অন্তর তিন বার ফসল তোলা যাবে।
বাঁশের ট্রে-তে মাশরুম চাষ
চাষের পদ্ধতিটা আগের মতোই। খালি পাত্র আলাদা। এক্ষেত্রে শোধন করে ভেজা খড়ের জল ঝরিয়ে নিয়ে বাঁশের ট্রে-তে প্রথমে ২ ইঞ্চি পুরু করে বিছিয়ে নিতে হবে। এর উপর হাল্কা করে বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার পর আবার ১ ইঞ্চি পুরু খড়ের স্তর দিতে হবে। তারপর হাল্কা বীজ ছড়িয়ে আবার ১ ইঞ্চি খড়ের স্তর দিতে হবে। শেষের খড় বিছানোর পর কালো পলিথিনের চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। মাঝে-মধ্যে ঢাকনা খুলে হাল্কা জল স্প্রে করতে হবে। ১৮-২০ দিন পর মাশরুমের কুঁড়ি বের হতে শুরু করলে উপরের পলিথিনের চাদর সরিয়ে দিন। দু’দিনের মধ্যে ফসল তোলা যাবে।
সতর্কতা
অনেক রকম আগাছা ও রোগপোকার সমস্যা দেখা যায় মাশরুম চাষে। একবার আক্রমণ হলে দমন করা খুবই কঠিন। তাই পরিষ্কার জায়গায় চাষ করতে হবে। পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। নয়তো বাড়িতে চাষ করা মাশরুমও রোগপোকার আক্রমণে বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে। বাজার থেকে কিনলে ভয়টা আরও বেশি। কারণ, খালি চোখে বিষাক্ত ছত্রাক চেনা যায় না। তবে কিছু সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। যেমন, বিষাক্ত ছত্রাক কিছুটা গরম জলে রেখে কিছুক্ষণ পর একটি রান্নার চামচ দিয়ে স্পর্শ করলে চামচের উপর কালো আস্তরণ পড়ে। ভোজ্য মাশরুমে এটা হয় না। একটা গ্রাম্য টোটকাও আছে। ক্ষুধার্ত মুরগিকে খেতে দিলে তারা যদি না খায়, বুঝতে হবে সেটি বিষাক্ত ছত্রাক। এছাড়া যে সমস্ত ছত্রাক উজ্জ্বল রঙের, তিক্ত স্বাদ ও দুর্গন্ধযুক্ত সেগুলি বিষাক্ত। বিষাক্ত ছত্রাক দুধে দিলে দুধ ফেটে যায় বা জমে যায়।
বিষাক্ত ছত্রাক খেয়ে ফেললে গা বমি ভাব, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যাথা হয়, ঘাম ঝরে। এমনকী মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই মাশরুম খাওয়ার আগে ভাল ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নেবেন।
লেখক: ফার্ম ম্যানেজার,
মালদহ কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র