কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে পুজো প্যান্ডেল চত্বরে নো এন্ট্রি জোন। তার মধ্যেই দূর থেকে দর্শকদের উঁকিঝুঁকি। ছবি: পিটিআই
শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপেই কাজ হল। পুজোর ভিড় এবং সেই বাবদে সামাজিক দূরত্ব শিকেয় তুলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করছিল গোটা রাজ্য এবং শহরের একটা বড় অংশ। চিকিৎসকরাও বারবার অনুযোগ করছিলেন, অন্যান্যবারের মতো পুজোর ভিড়, মণ্ডপে মণ্ডপে দর্শকের স্রোত করোনা সংক্রমণকে আরও ভয়াবহ আকার দেবে। এই পরিস্থিতিতে নমো-নমো করে পুজো করাই ভাল। ‘উৎসব’ নয়।
কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা এবং সাবধানবাণীকে কার্যত আমল না দিয়ে রবিবার রাতে থেকেই উদ্বেল জনতা বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। যে ছবি দেখে শিউরে উঠেছিল কলকাতাবাসীদের একটা বড় অংশ।
সোমবার আদালতের রায়ে সেই নাগরিকরা নিঃসন্দেহে স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁদের এই উদ্বেগও রয়েছে যে, শেষপর্যন্ত আদালতের রায় মেনে বড় পুজো মণ্ডপগুলিকে একেবারেই দর্শকশূন্য রাখা যাবে তো? যে শহর এবং তার লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের লকডাউনের কড়াকড়িও পুরোপুরি ঘরে আটকে রাখতে পারে না, যাঁদের অধিকাংশেরই মাস্ক পরতে অনীহা, তাঁরা কি পুজোর সময় ঘরে বসে ‘ভার্চুয়াল দর্শন’ করে সন্তুষ্ট থাকবেন? প্রতিটি মণ্ডপ ‘নো এন্ট্রি জোন’ করে কি সেই উৎসাহকে শেষমেশ ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, কেরলে ওনাম উৎসবের পর করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু-হু করে বেড়েছে। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় মহারাষ্ট্র বন্ধ রাখা হয়েছে আড়ম্বরের গণেশ পুজো। গুজরাতে বন্ধ রাখা হয়েছে নবরাত্রি উৎসব। সেই আবহে বাংলায় দুর্গাপুজো এবং তজ্জনিত উৎসবে রাশ না-টানায় চিকিৎসক মহল এবং রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ আতঙ্কে ছিলেন।
আরও পড়ুন: পুজো প্যান্ডেলে দর্শক নয়, স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দিল কলকাতা হাইকোর্ট
এদিন আদালতের রায়ে চিকিৎসক মহল খুশি। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ-প্রশাসন আদালতের নির্দেশ মেনে উদ্যোক্তারা নিয়ম মানছেন কি না, সেদিকে নজর রাখুক। ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস (ওয়েস্ট বেঙ্গল)’-এর আহ্বায়ক চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ বলেন, “অনেক আগে থেকেই আমরা জনতাকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। এখনও করছি। আদালতের নির্দেশের পর নিশ্চয়ই পুজো উদ্যোক্তারা এবং প্রশাসনের তরফেও বিষয়টি নজরে রাখা হবে। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ কৌশিক লাহিড়ি বলেন, “আদালতের রায়কে স্বাগত। কিন্তু ১০ মিটার বা ৫ মিটার দূরের ব্যারিকেডে যে জনস্রোত আছড়ে পড়বে, সেই ভিড় কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, তা নিয়ে কিন্তু দুশ্চিন্তা রয়েই যাচ্ছে। ভিড় আটকানো না গেলে কিন্তু সংক্রমণ আটকানো যাবে না।”
বস্তুত, চিকিৎসকদের একাংশ এমনও মনে করছেন যে, আদালত নয়। প্রশাসনের তরফেই আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। যা আরও সোজাসাপ্টা ভাবে বলেছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তাঁর কথায়, ‘‘এটা তো একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সুতরাং প্রশাসন বা সরকারের তরফেই এই সিদ্ধান্ত আসা উচিত ছিল। তা হলে আদালতের হস্তক্ষেপের কোনও প্রয়োজনই হত না। সারা দেশে করোনা ছড়াচ্ছে। সারা দেশ এক পথে চলছে। আর পশ্চিমবঙ্গের সরকার উল্টো পথ নিচ্ছে। ফলে আদালতে যাওয়া ছাড়া আর উপায়ও থাকে না।’’ পাশাপাশিই সেলিমের বক্তব্য, ‘‘কিন্তু যে সরকার আইন মানে না, সংবিধান মানে না, সেই সরকার আদালতের নির্দেশ কতটা মেনে চলবে আমাদের জানা নেই।’’
আরও পড়ুন: শহরের জঙ্গলে ফিরে আসুক দামা আর বসন্ত বউরি পাখিদের ডাক
আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েও রাজ্যের মন্ত্রী তথা একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “আদালতের রায়ের হলফনামা দেখে সরকার পদক্ষেপ করবে। আমাদের সেই নির্দেশ মানতে হবে। সব ক্লাবকে মানতে হবে। পুজোর দিনগুলোয় মণ্ডপগুলোকে নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চাঁদা তুলে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। রায় আগে হলে মানুষের টাকা জলে যেত না।” পুজোর পর সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন কলকাতার প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষও। করোনাজয়ী অতীনের কথায়, “এ বছর পুজো হওয়া উচিত। উৎসব নয়। আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। আদালতের রায় পুজো উদ্যোক্তাদের মেনে চলা উচিত।” অপর করোনাজয়ী মন্ত্রী তথা শ্রীভূমির পুজোর (যে পুজোর রবিবার ভিড়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করেছে) অন্যতম উদ্যোক্তা সুজিত বসুর কথায়, “সরকারি নিয়ম সকলকেই মানতে হবে। পুজো আমরা নিশ্চয়ই করব। কিন্তু এ বছর অন্য পরিস্থিতি। সে বিষয়টা মাথায় রাখতেই হবে।”
ঘটনাচক্রে, মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর উদ্যোক্তারা আদালতের রায়ের আগেই ‘দর্শকশূন্য’ পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওই পুজো কমিটির কর্ণধার সজল ঘোষ হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘‘সেরার সেরা উপাধি পাওয়ার লড়াই আগামী বছর হবে। এ বছরের পুজো হোক মানবতার।’’
আদালতের রায়ের পর মণ্ডপ থেকে ৫ বা ১০ মিটার দূরত্ব চিহ্নিত করতে ময়দানে নেমে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। বিকাল থেকেই মণ্ডপের বাইরে ভিড় নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেছে। তবু কিছু মণ্ডপে তৃতীয়ার সন্ধ্যাতেও ভিড় দেখা গিয়েছে। উদ্যোক্তাদের একাংশের আদালতের রায় নিয়ে কিঞ্চিৎ প্রশ্নও রয়েছে। তাঁদের মতে, মণ্ডপের বাইরে নো-এন্ট্রি বোর্ড ঝোলানো হলে ৫ বা ১০ মিটার দূর থেকে প্রতিমা দর্শন কী ভাবে হবে? ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বসু বলেন, “আদালতের রায় নিশ্চয়ই মানব। রায়ে কী বলা হয়েছে, তা দেখতে হবে। তবে শেষ মুহূর্তে এই রায়ে অসুবিধা হবে ক্লাবগুলোর। রাজ্য সরকারের নির্দেশ মেনেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ভিড় নিয়ন্ত্রণেও ব্যবস্থা নিয়েছিল প্রায় সমস্ত ক্লাব। স্যানিটাইজার, মাস্ক কেনা হয়ে গিয়েছে। মণ্ডপে ঢোকা থেকে বেরোনোর পথ বেশি করা হয়েছে। মানুষ যদি ৫ বা ১০ মিটার দূর থেকে চলে যান, তা হলে এ সবের প্রয়োজন ছিল না। আবার ১০ মিটার দূরে যদি এক সঙ্গে অনেক মানুষের জমায়েত হয়, তা হলেও তো সংক্রমণ ঘটতে পারে!” কাশী বোস লেন দুর্গাপূজার সাধারণ সম্পাদক সোমেন দত্তের কথায়, “থিম এবং শিল্পী-সহ অনেক ব্যয় করতে হয়। প্রথম থেকেই সঠিক রূপরেখা ঠিক করা হলে সেই টাকা জনস্বার্থমূলক কাজে খরচ করা যেত।”