পায়ে প্লাস্টার, হাতে দু’হাজারের নোট নিয়ে কৃষ্ণাদেবী। মঙ্গলবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
ফোনটা বেজেই চলেছে। ধরছেনই না ডাক্তারবাবু। বহু বার বাজার পরে যদিও বা ধরলেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট-প্রত্যাশী রোগীকে জানিয়ে দিলেন, আপাতত ক’দিন চেম্বার বন্ধ। কেন? ডাক্তারবাবুর জবাব, ‘‘আপনারা খুচরো দিতে পারবেন না। আর আমিও পাঁচশো-হাজারের নোট নেব না। তাই শুধু শুধু ঝামেলা না বাড়িয়ে আপাতত দিন কয়েক চেম্বার বন্ধ।’’
শহরের এক নামী হৃদ্রোগ চিকিৎসকের চেম্বারে আপাতত দিন কয়েক এ হেন তালা ঝোলার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। নোট বাতিলের জেরে খুচরো ঝঞ্ঝাট এড়াতে এখন অনেকেই এই পথ বেছে নিচ্ছেন। মধ্য কলকাতার এক শিশু-রোগ চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, চলতি সপ্তাহে তিনি শুধু বিভিন্ন হাসপাতালে তাঁর অধীনে ভর্তি শিশুদেরই দেখবেন। চেম্বারের সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল।
এক স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক গত শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত চেম্বার করেননি। মঙ্গলবার তাঁর চেম্বারের ঝাঁপ খুলেছে। তাঁর কথায়, ‘‘কী করব? পরিচিত রোগীরা যদি এসে বলেন, ‘১০০ টাকার নোট নেই। ৫০০ টাকার নোট নিন, নয়তো ভিজিট পরে দেব’, তখন তো মুখের উপরে কিছু বলা যায় না। তার চেয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল।’’ পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হয়েছে? তাঁর জবাব, ‘‘পুরোপুরি হয়নি ঠিকই। তবে আগের চেয়ে ভাল।’’
বেশির ভাগ হাসপাতালেই ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে বিল মেটানো চলছে। কোথাও চলছে নেট ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে। ওষুধের দোকানে বহু ক্ষেত্রেই পুরনো নোট চলছে। তবে খুচরো ফেরত দিচ্ছেন না অনেকেই। পরিবর্তে ‘ডিউ স্লিপ’ ধরিয়ে দিচ্ছেন। যাতে সেই স্লিপ দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারকে ঘিরে। যাঁরা বিভিন্ন ক্লিনিকে চেম্বার করেন এবং ফি নেওয়া হয় সেই ক্লিনিকের কাউন্টারেই, সেখানে সমস্যা কম। কারণ ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে ফি দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যাঁরা নিজেরা সরাসরি ফি নেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই হয়েছে সমস্যা। ৭০০-৮০০ টাকা ফি হলে রোগীর পক্ষে তা দেওয়া খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। অনেক রোগীই চেক নিয়ে আসছেন।
আবার ক্লিনিকে বসা যে ডাক্তারেরা ফি-টা সরাসরি নেন, সমস্যার সমাধানে নতুন নতুন পন্থা খুঁজে বার করছেন তাঁরা। যেমন, দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লিনিকের মেডিসিনের এক চিকিৎসক জানালেন, ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি রোগীর প্রেসক্রিপশনে বেশ কয়েকটি পরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন, যার মধ্যে কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হবে। আর কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হবে না, কিন্তু সেই পরীক্ষাগুলির খরচ যোগ করলে তাঁর ফি-এর অঙ্কটা দাঁড়াবে। ক্লিনিকে সবগুলিরই বিল হচ্ছে। তার পরে যে পরীক্ষাগুলি করা হচ্ছে, শুধু সেগুলির টাকা ক্লিনিক নিচ্ছে। বাকিটা ক্লিনিক মিটিয়ে দিচ্ছে ডাক্তারকে। রোগীকে জানিয়েই সবটা হচ্ছে। কারণ, ‘‘এ ছাড়া তো কোনও উপায় নেই,’’ বললেন তিনি।
বেসরকারি হাসপাতালগুলিও এই পরিস্থিতিতে নিত্যনতুন ব্যবস্থা নিচ্ছে। সল্টলেকের একটি চোখের হাসপাতালের কর্তারা জানান, টাকা না থাকলেও তাঁরা রোগীদের ফেরাচ্ছেন না। আউটডোর টিকিট, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই হচ্ছে। রোগীদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখছেন তাঁরা এবং পরে সুবিধামতো এসে টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন।
বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালও এ ভাবে ধারে চিকিৎসা করছে। জরুরি ও জীবনদায়ী চিকিৎসার ক্ষেত্রে নগদ টাকা না থাকলে ‘পেয়িং লেটার’ লিখিয়ে নিচ্ছে তারা। তাতে লেখা থাকছে, পরবর্তী সময়ে টাকা শোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকছেন সেই রোগী।
তবে সর্বত্রই যে ছবিটা এমন স্বস্তির, তা কিন্তু নয়। বেলেঘাটার এক নার্সিংহোমে কার্ডে পেমেন্ট নেওয়া হয় না। তাই ডাক্তার রোগীকে ছুটি দেওয়ার কথা জানিয়ে দিলেও বাড়ি নিয়ে যেতে পারছেন না পরিজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, হাসপাতালকে বারবার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তারা চেক নিচ্ছে না। যে টাকা বিল হয়েছে, তা এক সঙ্গে নগদে মেটানোও অসম্ভব। ফলে, অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছে ওই পরিবার।
কিংবা ধরা যাক কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। পুজোর সময়ে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল ৬৫ বছরের কৃষ্ণাদেবীর। প্লাস্টার করা হয়েছিল। সল্টলেকের এক পলি ক্লিনিকে এ দিন প্লাস্টার কাটার কথা ছিল। সে জন্য খরচ পড়ার কথা ১৩৪০ টাকা। ২০০০ টাকার নোট দিয়েছিলেন কৃষ্ণাদেবী। কিন্তু সেই নোট ফেরত দেওয়া হয়। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, তাঁরা ওই নোট নিয়ে বাকি টাকা খুচরোয় মেটাতে পারবেন না। ফলে এ দিন প্লাস্টার কাটাই হয়নি তাঁর। এ বার কী করবেন , সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই এই বৃদ্ধার কাছে।