রোগী যখন কাছে, মোবাইল থাক দূরে

আপাতদৃষ্টিতে বজ্র আঁটুনি। অথচ তারই মাঝে ফস্কা গেরো দিয়ে ঢুকে পড়ছে বিপদের বীজ! তা-ও খাস হাসপাতালের আইটিইউ বা আইসিসিইউয়ে, এবং খোদ ডাক্তারবাবুর হাত ধরেই! ডাক্তারবাবু অবশ্য নিয়মমাফিক হাত ধুয়ে ধুয়ে প্রতি রোগীকে পরীক্ষা করছেন। করতে করতেই বেজে উঠছে পকেটের মোবাইল ফোন। ফোন বার করে কথা সেরে ফের তিনি রোগী দেখায় মন দিচ্ছেন। আবার ফোন বাজছে। আবার একই ব্যাপার।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০২:১৬
Share:

আপাতদৃষ্টিতে বজ্র আঁটুনি। অথচ তারই মাঝে ফস্কা গেরো দিয়ে ঢুকে পড়ছে বিপদের বীজ! তা-ও খাস হাসপাতালের আইটিইউ বা আইসিসিইউয়ে, এবং খোদ ডাক্তারবাবুর হাত ধরেই!

Advertisement

ডাক্তারবাবু অবশ্য নিয়মমাফিক হাত ধুয়ে ধুয়ে প্রতি রোগীকে পরীক্ষা করছেন। করতে করতেই বেজে উঠছে পকেটের মোবাইল ফোন। ফোন বার করে কথা সেরে ফের তিনি রোগী দেখায় মন দিচ্ছেন। আবার ফোন বাজছে। আবার একই ব্যাপার।

এ ভাবে সব রোগীকে দেখে ডাক্তারবাবু আইটিইউ থেকে বেরোলেন। পরনে ‘স্টেরাইল গাউন।’ প্রতি রোগীকে দেখার আগে হাতও ধুয়েছেন। তা হলে তো হাসপাতালে তৈরি হওয়া সংক্রমণের (হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন) ঝুঁকি এড়াতে নিজের তরফে যাবতীয় নিয়মই তিনি মেনেছেন! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কখনওই নয়। রোগী দেখতে দেখতে তাঁর ওই মোবাইল ফোনে বাক্যালাপই সংক্রমণের আশঙ্কা এক ধাক্কায় বিস্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। কী ভাবে?

Advertisement

হাসপাতালের পরিষেবা-মান নির্ণায়ক সংস্থা ‘ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর হসপিটাল্‌স অ্যান্ড হেল্‌থকেয়ার প্রোভাইডারস (এনএবিএইচ)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গিরধর জে জ্ঞানীর ব্যাখ্যা, ‘‘রোগী দেখতে দেখতে ডাক্তার মোবাইলে কথা বলছেন। তাঁর হাত থেকে জীবাণু যাচ্ছে মোবাইলে। রোগী দেখা শেষে ডাক্তার হাত ধুয়ে নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু মোবাইল তো ধুচ্ছেন না! তাই পরের রোগীকে পরীক্ষার সময়ে উনি ফের ফোন ধরলে মোবাইলে লেগে থাকা জীবাণু তাঁর হাতে যাবে। সেখান থেকে রোগীর শরীরে।’’ এবং এই যুক্তিতেই আইটিইউ, আইসিসিইউ, অপারেশন থিয়েটার তো বটেই, বার্ন ইউনিট, নার্সারি ও লেবার রুমেও মোবাইল নিষিদ্ধ করা দরকার বলে ওঁরা মনে করছেন। সোমবার দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালে আয়োজিত ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’ সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে জ্ঞানীর এ হেন বক্তব্য অনেকেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। মিশন হাসপাতালের চেয়ারম্যান তথা, কার্ডিয়াক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মন্তব্য, ‘‘একেই বহু লোক অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে খেয়ে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বানিয়ে ফেলছেন। তাঁরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হলে রোগটা সারলেও হয়তো হাসপাতাল থেকে অন্য সংক্রমণ বাসা বাঁধছে শরীরে।’’ সত্যজিৎবাবুর মতে, ওয়ার্ডের অপরিচ্ছন্নতা নিঃসন্দেহে বড় বিপদ। আবার ডাক্তারের হাতের মোবাইল ফোন, গলার টাই বা ফুলশার্টের হাতও হয়ে উঠতে পারে সংক্রমণের বাহক। ‘‘এ নিয়ে অনেক বেশি সচেতনতা দরকার।’’— বলছেন তিনি।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

মাইক্রোবায়োলজিস্ট দেবকান্ত প্রধানও এক মত। দেশের বড় বড় শহরের সমীক্ষা বলছে, হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। শুধু ই-কোলাই প্রায় ৩০%। মূত্রনালীর সংক্রমণ, ভেন্টিলেটর অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া, রক্ত বা স্যালাইনের চ্যানেল থেকে সংক্রমণ তো আছেই।

‘হসপিটাল ইনফেকশন সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ কিছু নিয়ম বাধ্যতামূলক করায় জোর দিয়েছে। হাসপাতালের মান নির্ণয়ে ‘সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ’ও এখন অন্যতম মাপকাঠি। এনএবিএইচ-কর্তারা জানাচ্ছেন, এ জাতীয় ছাড়পত্র রোগীদের মনে আস্থা জাগায়। কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা মেলে। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল তাই ছাড়পত্র পেতে উঠে-পড়ে লেগেছে। এমনকী, কেরল-তামিলনাড়ু-গুজরাত-অন্ধ্র বা দিল্লির কিছু সরকারি হাসপাতালও তা আদায় করেছে। আর পশ্চিমবঙ্গে?

গিরধর জ্ঞানীর আক্ষেপ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ কোনও হেলদোল নেই।’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘এত দিন কিছু ভাবা হয়নি। এ বার শুরু হয়েছে। সময় লাগবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রমণের হার বেশি। তাদেরই বিশেষ ভাবে সক্রিয় হওয়া দরকার।’’ যা শুনে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র তরফে রূপক বড়ুয়ার বক্তব্য, ‘‘বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ দল নিরন্তর কাজ করছে। সকলে অনেক বেশি সচেতন। তাই বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ বেশি, এমন ভাবার জায়গা নেই।’’

বিপদ মোকাবিলায় নার্সরাও ভূমিকা নিতে পারেন। রোগীর পাশে বেশি সময় তাঁরাই থাকেন। নার্সদের জন্য একটি বিশেষ কোর্স চালু করেছে অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্‌থকেয়ার প্রোভাইডারস, এ দিন দুর্গাপুরের হাসপাতালে যার সূচনা হল। নার্সদের বিভিন্ন সংগঠনের মতে, সরকারি নার্সদেরও প্রশিক্ষিত করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়াস জরুরি। আরও জরুরি তা অব্যাহত রাখা। ‘‘এক বার ছাড়পত্র পেয়ে ঢিলে দিলাম, এতে কাজের কাজ কিছু হবে না।’’— হুঁশিয়ারি এক চিকিৎসকের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement