—প্রতীকী চিত্র।
দিনের শেষে মোবাইলে আসা মেসেজে হাসপাতালের বিল দেখে পরিজনেরা প্রতিদিনই ভাবতেন, এর শেষ কোথায়? দিন যত এগোচ্ছিল, ক্রিটিক্যাল কেয়ারে থাকা রোগীর চিকিৎসার খরচ ততই বাড়ছিল। দশ দিনেই তা ঠেকল প্রায় ১৫ লক্ষ টাকায়। ধার করে সেই টাকা মেটানোর পরে আর খরচ টানা সম্ভব নয় বুঝে পরিজনেরা অনেক চেষ্টায় ওই রোগীকে ভর্তি করালেন সরকারি মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ বা সিসিইউ-তে।
খরচের বোঝা টানতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতাল ছেড়ে সঙ্কটজনক রোগীকে নিয়ে এসে ভর্তি করার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই তিন-চারটি করে ঘটে শহরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে। তাতেই ফাঁপরে ওই সমস্ত হাসপাতাল। কারণ, বেসরকারি জায়গা থেকে আসা রোগীতেই ৭ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তি থাকছে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ বা সিসিইউ। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বা প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সুপারিশ ও চাপ থাকে ভর্তির জন্য। রোগীর পরিজনেরাও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দৌড়ঝাঁপ করে শয্যার ব্যবস্থা করেন। ভেন্টিলেশনের রোগীদেরও আনা হয়।
এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলির কর্তারা। তাঁদের কথায়, ‘‘এর ফলে নিজেদের হাসপাতালে থাকা রোগীরা আচমকা সঙ্কটজনক হয়ে পড়লেও তাঁকে আইসিইউ বা সিসিইউ-তে শয্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্কটজনক রোগী সরাসরি সরকারি হাসপাতালে এসেও শয্যা পান না।’’ কর্তাদের দাবি, এর ফলে অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কেউ আবার অনন্যোপায় হয়ে সম্পত্তি বিক্রি করে বেসরকারি হাসপাতালেই ভর্তি হচ্ছেন। পরে হয়তো সেই রোগীও আসছেন সরকারি হাসপাতালে।
অভিজ্ঞ সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘খরচ জোগাতে না পারলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে, আর তার পরে দায় সরকারি হাসপাতালের, এটা হবে কেন? এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের চিন্তা করার সময় এসেছে। নির্দিষ্ট নিয়ম করা প্রয়োজন।’’ ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘বিনামূল্যে চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসাথীর চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনে রাজ্য ভরে গেলেও এই ঘটনা বেড়ে চলেছে। তবে ক্রিটিক্যাল কেয়ারে শয্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়া উচিত।’’ স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে বার বারই বলা হয়, টাকা নয়, চিকিৎসা আগে। চিকিৎসার খরচও আগাম জানাতে বলা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই রোগীর শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনে চিকিৎসার খরচও বেড়ে যায়। তবে টাকার জন্য চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়া বা অন্য সমস্যায় এখন ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটারি কমিশন হস্তক্ষেপ করছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আইসিইউ বা সিসিইউ-র ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা নজরে এসেছে। মেটানোর চেষ্টা চলছে।’’
সমস্যা কতটা উদ্বেগের, তা বোঝা যায় শহরের দুই সরকারি হাসপাতাল— কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও এসএসকেএমের অবস্থা দেখলেই। সূত্রের খবর, খাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ৪৪টি শয্যার অন্তত ৫০ শতাংশ ভর্তি থাকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আসা রোগীতে। এসএসকেএমে আগে মাসে তা ছিল অন্তত ২৫ শতাংশ। কর্তৃপক্ষের দাবি, অনেক কমিয়েও এখনও তা সাত শতাংশ রয়েছে। শহরের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, বেসরকারি হাসপাতালে বেশ কয়েক দিন থাকার সময়ে দামি ও উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক পান রোগী। এর পরে যখন সেই রোগীকে সরকারি স্তরে আনা হচ্ছে, তখন সেখানকার অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করতে চাইছে না। আবার, দীর্ঘ দিন এক হাসপাতালের আইসিইউ বা সিসিইউ-তে থাকার ফলে সেখান থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসছেন অনেকেই।
শহরের একটি মেডিক্যাল কলেজের কর্তার কথায়, ‘‘রোগী স্থিতিশীল হওয়ার পরেও অন্য ওয়ার্ডে পাঠানোর কথা বললে অনেকে সময়ে পরিজনেরা আপত্তি করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে আর কিছু ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই জানার পরেও রোগীকে রেখে দিতে হয়। এ ভাবে শয্যা কমে যায়।’’ আর এক মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমরা তো চিকিৎসা না করে ফেলে রাখতে পারি না। তাই সব দায় আমাদেরই।’’