সদর হাসপাতালে পাপিয়া খাতুন। পাশে তাঁর ছেলেকে কোলে নিয়ে পাপিয়ার মা সাহিনুর মিস্ত্রি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
বিজেপি নেতারা দাবি করেছিলেন, অ্যাম্বুল্যান্সে কেউ ছিলেন না।
দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ দাবি করেছিলেন, কৃষ্ণনগরের রাস্তায় তাঁর সভায় গন্ডগোল পাকাতেই ওই অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়েছিল।
সত্যিটা হল, দিলীপ যখন রাস্তার পাশে বাঁধা মঞ্চ থেকে হুঙ্কার দিচ্ছেন, ‘এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না’, অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আসন্নপ্রসবা। সোমবারের ওই ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে নদিয়ার কোতোয়ালি থানায় দিলীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ রুজু করা হয়েছে।
ওই অ্যাম্বুল্যান্সে ছিলেন ধুবুলিয়ার হরিণডাঙা গ্রামের পাপিয়া বিবি। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁকে ধুবুলিয়া গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণনগরে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ে কালেক্টরি মোড়ের কাছে রাস্তা জুড়ে সভা করছিলেন দিলীপ। সেখান থেকে গাড়িতে মিনিটখানেক গেলেই সদর হাসপাতাল।
কিন্তু মঞ্চের ডান দিক থেকে হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স আসতে দেখে মাইকে দিলীপ বলেন, ‘‘এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। লোকে রাস্তায় বসে রয়েছে। ডিসটার্ব হয়ে যাবে। ঘুরিয়ে অন্য দিক দিয়ে নিয়ে যান।’’
বুধবার হাসপাতালে শুয়ে পাপিয়া বলেন, ‘‘অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল পেটে। হঠাৎ টের পেলাম, কারা যেন অ্যাম্বুল্যান্স আটকে দিয়েছে। চালক বারবার অনুরোধ করছেন রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু উল্টো দিকের লোকেরা রাজি হচ্ছে না। মনে-মনে আল্লাকে ডাকছি আর ভাবছি, পেটের সন্তানকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারব কি না।’’
পাপিয়ার মা সাহিনুর মিস্ত্রি ছিলেন মেয়ের সঙ্গে। তিনি জানলা দিয়ে মুখ বার করে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে থাকেন, তাঁদের রাস্তা ছাড়ার জন্য। কিন্তু তাতেও কেউ রাস্তা ছাড়তে রাজি হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘তখন মাইকে এক নেতা বলছেন, অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নিতে হবে। মেয়েটা পাগলের মতো ছটফট করছে। চালকও বারবার অনুরোধ করছেন। উল্টে মিটিংয়ের কিছু লোক উঠে এসে অ্যাম্বুল্যান্স পিছনে ঠেলছে।’’
চালক রথীন্দ্রনাথ বিশ্বাস বছর দুই হল এই রুটে অ্যাম্বুল্যান্স চালাচ্ছেন। কিন্তু কৃষ্ণনগরের রাস্তা-গলি তাঁর তত চেনা নেই। অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে তিনি পথচলতি লোকেদের জিজ্ঞাসা করে এগোতে থাকেন। কিন্তু কিছুটা গিয়ে দেখেন, রাস্তায় গর্ত করে মাটির তলা দিয়ে বিদ্যুতের কেব্ল পাতা হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ফের অ্যাম্বুল্যান্স ঘোরান। খানিক বাদেই আবার সামনে পড়ে তৃণমূলের মিছিল। কিন্তু মিছিলের লোকেরা রাস্তা করে দেন। রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘এক মিনিটের রাস্তা ঘুরে আসতে লেগে গেল প্রায় ২৫ মিনিট। কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি।’’
ওই রাতেই অস্ত্রোপচারে পাপিয়ার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। তিনি বলেন, ‘‘খুব অসহায় লাগছিল তখন। ভাবছিলাম, যে লোকটা মাইকে আমাদের ঘুরপথে যেতে বলছে, তার বাড়িতেও হয়তো মা-বোন আছে। তাদের যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হত, তিনি কি করতেন? ওই মিটিংয়ে যে মহিলারা আছেন, তাঁরাও তো কারও মা-বোন। তাঁরাই বা কেন এগিয়ে এসে আমাদের রাস্তা করে দিচ্ছেন না?’’
এ দিন বারবার চেষ্টা করেও দিলীপ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।