দিলীপ বসাক এখন পেন বানাতে চান। পেন সারানো এখন আর তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ নয়।
দেবেন্দ্র ঘোষ স্ট্রিট। জদুবাবুর বাজারের উল্টোদিকের সরু গলি। কী ভাবে যাব বলাতে উত্তর ছিল ‘মদন মিত্রের গলি’। কলকাতায় এই গলির পরিচয় যাই হোক না কেন, ভারতব্যাপী ঝরনা কলমপ্রেমী মানুষের কাছে কিন্তু এই গলি দিলীপ বসাকের ‘কারখানার’ জন্যই বিখ্যাত।
কারখানা! সে নামেই। দু’দিকে দুটো দোকানের মাঝে চিড়ে চ্যাপ্টা এক ফালি ঘর। আর এটাই এখন দেশের পেন সারানোর কাশী।
আশির দশকের শেষ থেকেই বল পয়েন্ট পেনের গুঁতোয় ঝরনা কলমের বাজার শেষ হয়ে যায়। সরকারি আমদানি নীতিও তার জন্য অনেকটাই দায়ী। আর তারই চাপে কালি ও কলমের বাজার কোনওরকমে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকে। ঠিক যে ভাবে বেঁচে আছে অ্যাম্বাসাডর গাড়ি সারাইয়ের গ্যারাজ।
আর টিকে যাওয়ার দলে যাঁরা নাম লিখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে দিলীপ বসাক অন্যতম। “আমি ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পেন সারাইয়ে নামি। আমি আর কিছুই জানি না। তাই এটাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয়েছে।” নিপাট স্বীকারোক্তি দিলীপের।
চম গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ঝরনা কলম সংগ্রাহক হিসাবে। তাঁর সংগ্রহে সাত হাজার কলম। বিভিন্ন সময়ের। গিয়েছিলাম তাঁরই সঙ্গে। চমের সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন, “উনি এখন আধুনিক যুগের রাধিকানাথ সাহা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।”
আমরা ভুলে গেলেও ঝরনা কলমপ্রেমীরা ভোলেননি রাধিকানাথ সাহা এবং ঝরনা কলমের দুনিয়ায বাঙালির অবদান। সুলেখা কালির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই প্রজন্ম জানে না রাধিকাবাবুর কথা। সম্ভবত ভারত থেকে ঝরনা কলমের আন্তর্জাতিক পেটেন্ট নেওয়াতে তিনিই প্রথম। গবেষক শোভন রায়ের কল্যাণে সেই ইতিহাস কিন্তু আমাদের হাতের মুঠোয়। তাঁর তৈরী লক্ষ্মী পেনে লিখেছেন গান্ধীজী, বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মৌলানা আজাদ। বাংলার প্রথম গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের মতো ইংরাজ শাসকরাও ব্যবহার করতেন তাঁর পেন। ১৯১৬ সালে এই পেনের দাম ছিল দু’টাকা আট আনা! ছিলেন এইচপি গুপ্ত এবং আরও অনেকেই দেশি পেন তৈরির বাজারের কুলীন হিসাবে।
ঝরনা কলমে বাংলার ঐতিহ্যরক্ষার পতাকাটা বহন করে চলেছেন দিলীপ।
এ রকম নয় যে কলকাতায় ঝরনা কলম তৈরি হয় না। হয়। তবে তা টিকে আছে কুটীর শিল্প হিসাবেই। কিন্তু ভারতে তৈরি ঝরনা কলমের কৃষ্টি বহন করার দায় নিয়ে নিয়েছে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত।
দিলীপ বসাক এখন পেন বানাতে চান। পেন সারানো এখন আর তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ নয়। তাঁর ইচ্ছা বিখ্যাত পেন প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠা। আমরা অনেকেই জানি না যে আমাদের দেশে তৈরি পেনের দাম ২০ টাকা থেকে ২০ হাজার পেরিয়ে লাখও ছুঁতে পারে। ঝরনা কলমপ্রেমীরা শুধু যে ব্র্যান্ড ধরে পেন কেনেন তা নয়। হাতে বসে, লেখার ধরনের সঙ্গে মিলিয়ে অর্ডার দিয়ে পেন বানিয়ে নেন অনেকেই। আর দাম হয়ে সেই চাহিদার নিরিখেই। সোনার নিব না স্টিলের? দেখতে কী রকম। কালি ধরে রাখতে কী প্রযুক্তি ব্যবহার হবে। দাম নির্ভর করে এ সবের উপরেই।
দিলীপ ধরতে চান সেই বাজারটাকেই। গোটা বিশ্বের নামী ব্র্যান্ডের পেন সারানোয় তাঁর খ্যাতি কিন্তু দেশের মাটি পেরিয়ে বিদেশের বিখ্যাত ঝরনা কলম সংস্থাদের কানেও পৌঁছেছে। “ভাল কারিগরের অভাব বিশ্ব জুড়েই। ফাউন্টেন পেনের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু তুলনায় কারিগর কোথায়? আমাকে অনেকেই চাইছেন তাঁদের সংস্থায়। কিন্তু এই শহর ছেড়ে কোথায় যাব?”
আজকের বল পেনের দুনিয়ায় আমরা ভুলেই গিয়েছি ঝরনা কলমের আভিজাত্য। এ কলম ব্যবহারে যেমন মজা, তেমনই খুঁতখুঁতে লেখকের কাছে কিন্তু তা বেহালার মতো। নিব এবং ওজন যদি আপনার হাতের চলনমাফিক না হয়, তা হলে কিন্তু ঝরনা কলমে লেখার শ্রেষ্ঠ মজা থেকে আপনি বঞ্চিত। এটা হতেই পারে লাখ টাকার পেনে লেখার থেকে আপনার হাতের চলনে মিলে গেল ৩০০ টাকার পেন! তা হলে ওই পেনেই আপনার নাম লেখা রয়েছে। কিন্তু এখানেই দিলীপদের কেরামতি বলে অনেকের দাবি। পেন সারানোর বাইরেও আপনার বেয়াড়া দামি পেনটাকে আপনার হাতের বাধ্য করে তুলতে চম গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় তিনি ‘মায়েস্ত্রো’। আর একে বলে টিউনিং। যা সবাই করতে পারে না। ওই বাদ্যযন্ত্রের মতোই। দিলীপের কেরামতি এখানেও।
কলকাতা থেকে পেন আসে সারাতে? “সে সব দিন শেষ। আমার কাছে বেশির ভাগ পেনই আসে পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারত থেকেই। এবং সংখ্যাটা বাড়ছে।” দিলীপের এই উত্তরের সমর্থন কিন্তু মেলে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে কলমপ্রেমীদের গোষ্ঠীর আলোচনাতেই। সেখানে যোগদানকারী কলমপ্রেমীর সংখ্যা আমাদের রাজ্যের থেকে পশ্চিম এবং দক্ষিণের রাজ্যেই বেশি।
বাংলা অনেক কিছুই হারিয়েছে। কিন্তু ঝরনা কলমে বাংলার ঐতিহ্যরক্ষার পতাকাটা বহন করে চলেছেন দিলীপ। কোনওমতে। শিল্পের মতো ঝরনা কলম কিন্তু বাজারে ফিরছে ওই দক্ষিণের আর পশ্চিমের রাজ্যগুলোর হাত ধরেই। দিলীপ কিন্তু হাওয়া ঘোরার গন্ধ পাচ্ছেন।