চুরি গিয়েছে বিষ্ণুর এই মূর্তিই। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
চুরি গেল ত্রিবিক্রম।
ত্রিবিক্রম বিষ্ণুর এক রূপ। হাওড়ার বালির একটি বাড়ির সদর দরজার তালা ভেঙে প্রায় হাজার বছরের পুরনো তাঁর প্রায় নিখুঁত একটি মূর্তি নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, মূর্তিটি মোটা টাকার বিনিময়ে পাচার করে দেওয়া হতে পারে। আবার অন্য কোনও কারণেও চুরি করা হতে পারে। তদন্ত শুরু করেছে বালি থানা ও হাওড়া সিটি পুলিশ। হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান অজয় ঠাকুর বলেন “কিছু সূত্র মিলেছে। তদন্তে সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজও করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে বেশি কিছু বলা যাবে না।”
প্রিয়নাথ ঘোষ লেনের ওই দোতলা বাড়িতে মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাস দীর্ঘদিনের। এখন বাড়িতে একাই থাকেন ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়। একতলায় কাঠের সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনে বাগান। তারপরে আবার একটি পলকা কাঠের দরজা দিয়ে ঢোকা যায় মূল বাড়িতে। তারপরে বাঁ দিকের ঘরের একটি দেওয়ালে বিরাট কুলুঙ্গির মধ্যে ছিল ওই মূর্তি। গত ১২ মার্চ থেকে মূর্তিটি নিখোঁজ। সে দিন রাতে বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই দেখেছিলেন, সদর দরজাটি ভাঙা। তখনই আশঙ্কা করেছিলেন, কোনও অঘটন ঘটেছে। সোজা মূর্তির ঘরে গিয়ে দেখেন কেবল বেদিটা পড়ে রয়েছে। মূর্তি নেই। ১৩ মার্চ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ইন্দ্রনীলবাবু।
তিন ফুটের উপর লম্বা ও এক ফুটেরও বেশি চওড়া ছিল মূর্তিটি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, “মূর্তিটির যা বিবরণ পাচ্ছি, তাতে পাল সেন যুগের শিল্প উৎকর্ষের মাপকাঠিতে এটি একটি মূল্যবান নিদর্শন।” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায়ের কথায়, “অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মূর্তিটির ওজন ৫০ থেকে ৬০ কেজি হওয়ার কথা।” কালো পাথরের এই মূর্তি তৈরি করা খুব সহজ ছিল না। বাংলায় এমন পাথর সাধারণত মেলে না। বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হত। তারপরে শিল্পীরা মূর্তি তৈরি করতেন। সেখানে মূল বিগ্রহের পাশে থাকে আরও কিছু বিগ্রহ। থাকে নানা অলঙ্করণ। যেমন বিগ্রহের মাথার উপরে সিংহের মুখ যা কীর্তিমুখ বলে পরিচিত। পায়ের নীচে প্রস্ফুটিত পদ্ম। ত্রিবিক্রমের মুকুটের দু’পাশে মালা হাতে রয়েছে বিদ্যাধরেরা। তা ছাড়া, মূল বিগ্রহের শিরোভূষণ, কোমরবন্ধ, কণ্ঠহার এবং বাহুর অলঙ্কারও জমকালো। তাই এই মূর্তি অটুট থাকলেই তার দাম বেশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপিকা সুদীপা রায় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সেকালে এত বড় মূর্তি সাধারণত মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করা হত। রাজা, বণিক বা বড় কোনও ভূস্বামীর পক্ষেই সম্ভব হত এই ভাবে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে বড় মূর্তি নানা কারণে ভেঙে যায়। তাই প্রায় অটুট মূর্তি কমই মেলে।
বিষ্ণুর ত্রিবিক্রম রূপ
• পাল-সেন যুগের শেষ দিকে ১১-১২ শতকে তৈরি
• সে যুগের শিল্পরীতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয়
• প্রায় নিখুঁত এমন মূর্তি বাংলায় বিরল
• শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণু দাঁড়িয়ে পদ্মের উপরে
• ভঙ্গি সমপদ স্থানক। অর্থাৎ দু’পায়ে সমান ভর দিয়ে
• বিষ্ণুর ডান দিকে লক্ষ্মী, বাঁয়ে সরস্বতী
মুখোপাধ্যায় পরিবার কোথা থেকে এই মূর্তি পেলেন? ইন্দ্রনীলবাবু বলেন, “ঠাকুরদা পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায় পুরাতত্ত্ব বিভাগে চাকরি করতেন। সেই সুবাদেই বহু বছর আগে তিনিই মূর্তিটি বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পর নিত্য পুজো করা হত।”
মঙ্গলবার ইন্দ্রনীলবাবুর বাড়ির পিছনের পুকুরে স্থানীয় ডুবুরি বীরেন কর্মকারকে নামায় পুলিশ। কিন্তু প্রায় ঘন্টা দেড়েক খোঁজার পরেও মূর্তি মেলেনি। বাড়ির ভিতরের পাতকুয়োতেও তল্লাশি চালানো হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। তাহলে কী মূর্তিটি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে পুকুরে কিংবা পাতকুয়োতে ফেলে দিয়েছে? এক পুলিশ কর্তার কথায়, মূর্তিটি যেমন ভারী ও বড় তাতে তা এক জনের পক্ষে সরানো সম্ভব নয়। দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় বেশ কয়েকজন ছিল বলেই মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোনও একটি বড় চক্র এর পিছনে থাকতে পারে। কলকাতা জাদুঘরের প্রাক্তন অধিকর্তা অনুপ মতিলাল বলেন, “এই ধরনের বিগ্রহের অর্থমূল্য নির্ধারণ করা খুবই শক্ত। কারণ, কার কাছে তা বিক্রি করা হচ্ছে, তার উপরে মূর্তির অর্থমূল্য নির্ভর করে।”
ভুবনেশ্বরের যক্ষীর কাটা মাথা দেখেই চিনে ফেলেছিলেন সিধু জ্যাঠা। মন্দিরের গা থেকে কেটে নেওয়া হয়েছিল অমূল্য প্রত্নসম্পদ। হাল্কা ছিল, তাই সুটকেসের মধ্যেই তা ভরে ফেলে গিয়েছিল। ফেলুদা শেষ পর্যন্ত তা উদ্ধার করে। জ্যৈষ্ঠ মাসের অধিপতি ত্রিবিক্রমের খোঁজ এ বার কত দিনে মিলবে, সেটাই প্রশ্ন। অমলবাবু বলেন, “মূর্তিটির নিবন্ধীকরণ হয়ে থাকলে, তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে। তাতে তা খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।”