অবশেষে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে রবিবার আরামবাগ মহকুমার ঘরছাড়া সিপিএম কর্মী নেতাদের ঘরে ফেরানোর কাজ শুরু করল পুলিশ ও মহকুমা প্রশাসন।
সিপিএমের পক্ষে নির্বাচন কমিশনের কাছে আরামবাগ মহকুমায় ৭৬৬ জন ঘরছাড়াদের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে রবিবার সকালে পুলিশি নিরাপত্তায় ঘরে ফিরেছেন ৮৬ জন। আরও ১৫ জন সোমবার ফিরবেন বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। বাদবাকিরা এখনও নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান বলে দলীয় সূত্রের খবর। মহকুমা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলিতে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে।”
আরামবাগ লোকসভা নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবু চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে তৃণমূলের লাগামছাড়া সন্ত্রাসে আমাদের প্রায় হাজার খানেক নেতা-কর্মী-সমর্থককে ঘরছাড়া হতে হয়। তাঁদের ফেরানোর আর্জি বহু দিন ধরেই করা হয়েছিল প্রশাসনের কাছে। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে সেই ব্যবস্থা হল।” ঘরছাড়াদের প্রসঙ্গে তৃণমূলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, “সিপিএমের দুষ্কৃতীরা নিজেরাই ঘর ছেড়েছে। কেউ তাদের মারধর করে তাড়ায়নি। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, যারা খুনের মামলায় অভিযুক্ত, তারা জামিন না নিয়ে এলাকায় যেতে পারবে না। বাকিদের কেউ বাধা দেবে না।”
ঘরছাড়াদের ফেরানোর প্রশাসনিক উদ্যোগহীনতার অভিযোগ মানেনি পুলিশ-প্রশাসন। পুলিশের বক্তব্য, ঘরছাড়াদের তালিকা খতিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশই বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে আত্মগোপন করে আছেন। অন্যদের বাড়ি ফিরতে অসুবিধা ছিল না।
সিপিএমের দলীয় সূত্রের খবর, খানাকুল, পুড়শুড়া, আরামবাগ এবং গোঘাটে বর্তমানে ঘরছাড়ার সংখ্যা যথাক্রমে ৪৪৬, ৬৭, ৭২ এবং ১৮৬। এ ছাড়াও, খানাকুলে ৯২টি মামলায় ১৩০০ কর্মী-সমর্থকের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পুড়শুড়ায় ৬৩টি মামলায় জড়ানো হয়েছে ১১০০ জনকে। আরামবাগে ১৪২টি মামলায় ১৩৪৭ জনকে ফাঁসানো হয়েছে বলেও তাদের দাবি। গোঘাটে ১৩৪টি মামলা দায়ের করে প্রায় ১৪০০ জনকে যুক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক হিংসার জেরে আরামবাগ মহকুমায় বিরোধীদের ঘরছাড়া হয়ে থাকার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। মহকুমার পরিবেশ এমনই যে চায়ের দোকানের জমজমাট আড্ডাতেও মেরুকরণ স্পষ্ট। সেখানে অন্য রাজনীতির লোক বঞ্চিত। এমনকী, রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রতিবেশীদের মধ্যেও সখ্যতা বিলুপ্ত। গ্রামের আটচালায় বা পাড়ার মাচায় বাকবিতণ্ডা দেখা যায় না। এই প্রভাব পড়েছে মহিলাদের মধ্যেও। জমির ফসল কিংবা বাড়ির রান্না করা খাবার নিয়ে প্রতিবেশীর মধ্যে আদান প্রদানের যে রীতি গ্রামগঞ্জের পরিচিত ঘটনা, তা-ও এখানে প্রায় বিলুপ্ত। এ সব নিয়ে মানুষর হা-হুতাশ আছে। কিন্তু করার কিছু নেই।
ঘরছাড়াদের নিয়ে প্রশাসন যে একেবারেই হাত গুটিয়ে বসে আছে তা অবশ্য নয়। দু’এক বার সর্বদল বৈঠক ডাকা হয় মহকুমাশাসক এবং বিডিও অফিসে। যদিও কোনও সমাধান সূত্র বের হয়নি। হুগলি জেলাশাসকের নির্দেশে আরামবাগ মহকুমাশাসকের ডাকা দু’বছরের মধ্যে দু’টি সর্বদল বৈঠকে তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য ছিল, সকলে ঘরে ফিরুক। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের ক্ষোভ আছে কিংবা যারা নানা দুষ্কর্মে জড়িত, তাদের ঘরে ঢোকালে অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সেই অশান্তি বা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের কোনও দায় থাকবে না বলে জানিয়ে দেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এরই প্রেক্ষিতে পুলিশও জানায়, ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রামের ঘরছাড়াদের সকলকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো তাদের নেই। এ ভাবেই ভেস্তে যায় সর্বদল বৈঠকগুলি। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবার দু’এক জন ঘরছাড়া নিজের দায়িত্বে ফিরে মারধর বা তাড়া খেয়ে ফের গ্রাম ছাড়েন, এমন অভিযোগও আছে। কারও কাছ থেকে আবার গ্রামে থাকতে গেলে জরিমানা চাওয়ারও অভিযোগ ওঠে শাসক দলের বিরুদ্ধে। টাকা না দেওয়ায় ফের গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন ওই সব সিপিএম নেতা-কর্মী। এ সব অভিযোগ যথারীতি উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, সিপিএমের জমানায় যারা একাধিক গোলমাল, সন্ত্রাসে জড়িত, তাদের গ্রামে থাকতে দিতে রাজী নন গ্রামবাসীরাই। এর পিছনে তৃণমূলের কোনও ইন্ধন নেই। এ দিন যাঁরা ঘরে ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যেও কয়েক জনকে রাতেই চলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। এই অভিযোগও মানেনি রাজ্যের শাসক দল।