ঋষভ জায়সবাল
বারো বছরের একমাত্র ছেলের খোঁজ মেলেনি পাঁচ দিন ধরে। নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছিল বাবা-মায়ের। থানা-পুলিশে ছোটাছুটি চলছিল। ছেলের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। মন্দির, দরগায় মানতও বাকি রাখেননি। কার্যত দিশেহারা দশা গোটা পরিবারের।
শেষমেশ সেই ছেলেরই দেহ মিলল বাড়ির একতলায়, সিঁড়ির পাশে পরিত্যক্ত গুদামঘরে। যে সিঁড়ি দিয়েই নিয়মিত দোতলায় নামা-ওঠা করতেন ছেলেটির বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্যেরা।
ঘটনাটি নৈহাটির গৌরীপুরের। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে টিউশন পড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কল্যাণী সেন্ট্রাল মডেল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ঋষভ জায়সবাল (১২)। তারপর থেকে খোঁজ মেলেনি তার। শুক্রবার নিজেদেরই বাড়ির একতলা থেকে ছেলের দেহ উদ্ধারের পরে জ্ঞান হারান মা অঞ্জু। বাবা রাজেশ কোনও মতে বললেন, “নীচের ঘরে কবে থেকে না জানি পড়ে আছে ছেলেটার দেহ। আর ওই সিঁড়ি দিয়েই তো ক’দিন ধরে কত বার ওঠানামা করলাম। কিছুই টের পেলাম না!”
রাজেশবাবুর পরিবহণের ব্যবসা। তাঁরই এক গাড়িচালককে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ওই চালকের সঙ্গে ক’দিন আগে গোলমাল বেঁধেছিল রাজেশের। ছেলেটিকে চড়-থাপ্পর মারেন রাজেশবাবু। সে সময়ে ওই যুবক ‘দেখে নেবে’ বলে হুমকি দিয়ে যায় বলে দাবি জায়সবাল পরিবারের। ২৩ তারিখ সেই যুবকের সঙ্গেই স্থানীয় গৌরীপুর বাজারে ঋষভকে শেষ দেখা গিয়েছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
এ দিন ব্যারাকপুর লাটবাগান থেকে পুলিশ কুকুর আনা হয়। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পদস্থ কর্তারাও হাজির হন ঋষভদের বাড়িতে। পরিচিত কেউ এই ঘটনায় জড়িত বলে এক রকম নিশ্চিত পুলিশ। কিন্তু খুন করে ঋষভের দেহ কেন বাড়িতেই লুকিয়ে রেখে যাবে খুনি, তা ভাবাচ্ছে পুলিশকে। তারা জানিয়েছে, ঋষভের মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। তবে তাকে শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে বলে অনুমান। দেহ পাঠানো হয়েছে ময়না-তদন্তে। ব্যারাকপুরের গোয়েন্দা প্রধান সি সুধাকর বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে আক্রোশবশত খুন করা হয়েছে ওই ছাত্রকে। তবে কে বা কারা খুনের সঙ্গে জড়িত, তা খতিয়ে দেখতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার সন্ধে থেকেই বাড়ির মধ্যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। ঘিঞ্জি এলাকায় গায়ে গায়ে অসংখ্য ঘর-বাড়ি। প্রতিবেশীরাও দুর্গন্ধের কথা বলাবলি করছিলেন। শুক্রবার দুর্গন্ধ আরও বাড়ে। তার উৎস খুঁজতে এ দিন সকালে বাড়ির একতলায় সিঁড়ির নীচে গুদাম ঘরের দরজা খোলেন রাজেশ। বহু দিন খোলা হয় না কাঠের একফালি সেই দরজা। নানা আবর্জনা স্তূপ সেখানে। কাছাকাছি যেতেই গন্ধটা যেন ধাক্কা দিচ্ছিল সজোরে। দরজা খুলতেই নাড়িভুড়ি গুলিয়ে ওঠার দশা। ঝুল-জঞ্জাল সরিয়ে কোনও রকমে ভিতরে ঢোকেন রাজেশ ও তাঁর ভাই সুদীপ। গাড়ির টায়ার আর পুরনো দরজার একটা পাল্লার পিছনে পলিথিন চাপা দেওয়া জায়গাটা থেকেই গন্ধ আসছে বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়েছিলেন রাজেশ। পলিথিন সরাতেই আর্তনাদ করে ওঠেন। ছেলের পচতে শুরু করা দোমড়ানো দেহের উপরে তখন মাছি উড়ছে।
সুদীপ বলেন, “২৩ তারিখ সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে টিউশন পড়তে গিয়েছিল ঋষভ। বাড়ি ফিরে আবার বেরোয়। আরও এক জায়গায় পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। গৌরীপুর বাজারে একটি তেলেভাজার দোকানে ওকে দেখতে পাওয়া যায়। পরে জানতে পারি, আমাদের এক গাড়িচালকের সঙ্গেই শেষবার দেখা গিয়েছিল ওকে।” ওই রাতেই থানায় অভিযোগ করেন জায়সবাল পরিবার। তাঁদের দাবি, ছেলেকে টিউশনে নিয়ে যেত ওই চালকই। তবে ঘটনার দিন ঋষভ একাই বেরিয়েছিল।
তার দাদু প্রদীপবাবু বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধের দিকে আমার মোবাইলে একটি ফোন আসে। হিন্দিতেই কথা বলছিল। তবে লাইনটা কেটে কেটে যাচ্ছিল। যতটুকু বুঝতে পারি, নাতিকে ফিরে পেতে গেলে টাকা দিতে হবে বলছিল। কিন্তু কথা বেশি এগোয়নি। আমার ফোনে চার্জ না থাকায় লাইন কেটে যায়। পরে আর ফোন আসেনি।” তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের অনুমান, অন্তত দিন দু’য়েক আগেই খুন হয়েছিল ঋষভ। মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে তারপরে।
ওই গাড়িচালক রাজেশের বাড়ির পিছনেই একটি ঘরে ভাড়া থাকেন। তাঁর মা বলেন, ‘‘ছেলেকে সন্দেহের বশেই রাজেশবাবুরা মারধর করেছেন। আমাকেও মেরেছেন। সোমবার পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়।”