ধৃত বিজয় বিশ্বাস।-নিজস্ব চিত্র।
পরিত্যক্ত বাগানে নারকেল কুড়োতে গিয়েছিল পাড়ারই কয়েক জন কিশোর। গাছের তলায় এক জায়গায় নারকেল পাতার স্তূপ সরাতেই তাদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। কারণ পাতার নীচে উপুড় হয়ে পড়ে এক মহিলার পচাগলা মৃতদেহ। ছুটে এলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জানা গেল, দেহটি সাত দিন আগে প্রতিবেশীর বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়ে নিখোঁজ স্থানীয় এক গৃহবধূর। ওই প্রতিবেশী যুবকের বাড়ি বাগানের পাশেই।
বালির নিশ্চিন্দা পূর্বপাড়ায় মঙ্গলবার সকালে এই ঘটনায় তুমুল চাঞ্চল্য ছড়ায় এলাকায়। পুলিশ জানায়, ওই বধূর নাম মালিয়া শিকদার (৩০)। সন্দেহ হওয়ায় বিজয় বিশ্বাস নামে ওই প্রতিবেশীকে এ দিন প্রথমে আটক করে পুলিশ। রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি, জেরায় ওই যুবক কবুল করেছে গত ৪ জুন সে-ই মালিয়াকে ধর্ষণ করে গলা টিপে খুন করেছিল। পরে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত বাগানে দেহটি ফেলে দিয়ে প্রমাণ লোপাট করতে মুখে অ্যাসিড ঢেলে নারকেল পাতা চাপা দিয়ে দেয়।
পুলিশ সূত্রের খবর, বালি নিশ্চিন্দা পূর্বপাড়ার বাসিন্দা সনৎ শিকদারের সঙ্গে বছর দশেক আগে বিয়ে হয়েছিল মালিয়ার। ওই এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন ওই দম্পতি। বিজয় তাঁদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকে। গত ৪ জুন বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ টিভি সিরিয়াল দেখতে বিজয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন মালিয়া। আর বাড়ি ফেরেননি। পরের দিন অর্থাৎ ৫ জুন নিশ্চিন্দা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন সনৎ। সেই ঘটনার পরে এ দিন ওই বধূর দেহ উদ্ধার হল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মালিয়ার খোঁজখবর থেকে এই সংক্রান্ত সব কাজেই সনতের বন্ধু হিসেবে সঙ্গে ছিল বিজয়।
পুলিশ জানায়, নিঃসন্তান মালিয়া বিজয়ের চার বছরের মেয়েকে খুব ভালবাসতেন। নিজেদের বাড়িতে টিভি না থাকায় বিজয়ের বাড়িতেই প্রতিদিন টিভি দেখতে যেতেন তিনি। ৪ জুন ঘটনার দিনে বিজয়ের স্ত্রী মুনমুন কাটোয়ায় দিদির বাড়িতে গিয়েছিলেন। সনৎও কাটোয়ায় গিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওই দিন দুপুরে সনতের বাড়িতেই দুপুরের খাওয়া সারে বিজয়। তার পরে নিজের বাড়িতে ফিরে যায়।
এর পরে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বিজয়ের বাড়িতে যান মালিয়া। তদন্তকারীদের দাবি, জেরায় ধৃত যুবক স্বীকার করেছে, সিরিয়াল দেখার পরে সে ওই বধূকে ধর্ষণ করে। মালিয়া সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার কথা বললে তাঁকে ভয় দেখায় বিজয়। তাতেও কথা না শোনায় সে মালিয়ার গলা টিপে ধরে বলে পুলিশের দাবি।
পুলিশের দাবি, জেরায় বিজয় জানিয়েছে, গলা টিপে ধরার পরে মালিয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ তাঁকে ঘরেই রেখে দেয় ওই যুবক। পরে মালিয়া মারা গিয়েছেন বুঝতে পেরে অন্ধকার হওয়ার পর তাঁকে বাড়ির লাগোয়া পরিত্যক্ত বাগানে নিয়ে যায় সে। দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে গিয়ে ভাঙা দেওয়ালের পাশে নারকেল গাছের তলায় মালিয়াকে ফেলে দেয় সে। তার পরে ঘর থেকে বাথরুম সাফাইয়ের ফিনাইল নিয়ে এসে তাঁর মুখে ঢেলে দেয়। শেষমেশ নারকেল পাতা দিয়ে মালিয়াকে সে ঢেকে দেয় বলে জেরায় জানায় বিজয়।
পুলিশের দাবি, বিজয় জানিয়েছে, ঘটনার দিন দুপুরে সনতের বাড়িতে খেতে যাওয়ার আগে পাড়ার একটি মুদিখানার দোকান থেকে সে অ্যাসিড কিনেছিল। ঘরে রাখা সেই অ্যাসিডই মালিয়ার মুখে ঢেলে দিয়েছিল প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায়। এ দিন যখন ওই গৃহবধূর মৃতদেহ উদ্ধার হয়, তখন পরিত্যক্ত বাগানটিতে ভিড় করেছিল গোটা পাড়া। কিন্তু বাড়ির লাগোয়া বাগানে পরিচিত মহিলার দেহ পাওয়া গিয়েছে শুনেও যায়নি বিজয়। বরং সে বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল বলে অভিযোগ।
স্থানীয় এক মহিলা জয়ন্তী রায়চৌধুরী বলেন, “বিজয়কে পালাতে দেখে আমরা ধরে ফেলি। সেদিন ওর বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়েই মালিয়া নিখোঁজ হয়েছিল।” বিজয়কে ধরে এলাকার ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে চড়থাপ্পড় মারতে থাকেন পাড়ার লোকজন। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আটক করে।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রথম থেকেই কয়েকটি বিষয়ে বিজয়ের উপর সন্দেহ হয়েছিল। ঘটনার দিন সে যে সনতের বাড়িতে গিয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে। কারণ, ওই বাড়িতে তার টুপি পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া মালিয়া যে তার বাড়িতে টিভি দেখতে ঢুকেছিলেন, তারও প্রত্যক্ষদর্শী আছে। কিন্তু বিজয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই বধূকে বাড়ি ফিরতে কেউ দেখেননি। এ দিন দেহ উদ্ধারের পর থেকেই বিজয়ের স্ত্রী-মেয়েও পলাতক ।
হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (উত্তর) রশিদমুনির খান বলেন, “কয়েকটি বিষয়ে সন্দেহ হওয়ায় আমরা বিজয়কে আটক করেছিলাম। কিন্তু পরে জেরায় ও নিজেই ধর্ষণ এবং দোষ ঢাকতে খুনের কথা স্বীকার করেছে।”