আক্রান্ত দলীয় কর্মীর বাড়িতে গিয়ে এক রাশ প্রশ্নের মুখে পড়েন বিমান বসু। ফেরার সময় শিশুকে আদর করে হাল্কা হওয়ার চেষ্টা তাঁর। শনিবার আরামবাগে। ছবি: মোহন দাস
আপনাদের ডাকিনি। কেন এসেছেন?
আপনারা চলে যাবেন। ওরা আসবে। কে বাঁচাবে আমাদের?
মহিলার একের পর এক ঝাঁঝালো প্রশ্ন ভেসে আসছিল বাইরের চাতাল থেকে। দলীয় কর্মীর ভাঙচুর হওয়া ঘরে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রীর ওই প্রশ্ন শুনে থ বিমান বসু-সহ বামফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্ব। ভাবতেই পারেননি শনিবার আরামবাগে তৃণমূলের ‘হামলা’য় দলীয় কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর দেখতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে তাঁদের!
লোকসভা নির্বাচনের আগে-পরে আরামবাগের পুইন, জয়সিংহচকের মতো কয়েকটি গ্রামে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের মারধর, তাঁদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজির একের পর এক অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে। শাসক দল সেই অভিযোগ মানেনি। ইতিমধ্যেই ঘরছাড়া হয়েছেন ওই দুই এলাকার বেশ কয়েক জন বাম কর্মী-সমর্থক।
চেয়ারম্যান বিমান বসুর নেতৃত্বে শনিবার ‘সন্ত্রাস কবলিত’ ওই দুই গ্রামে যান রাজ্য বামফ্রন্টের নেতারা। সেই দলে ছিলেন সিপিএম নেতা রবীন দেব, সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদার, আরএসপি রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নরেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বাম নেতারা জানান, আরামবাগ-সহ গোটা রাজ্যে সন্ত্রাস বন্ধ করার দাবিতে তাঁরা আগামী ৯ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। বিমানবাবু বলেন, “তৃণমূল নির্বাচনে জিতে আমাদের লোকদের উপর ব্যাপক হামলা করছে। জঙ্গলের রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর বিহিত হওয়া উচিত। আমরা চাই রাজ্য সরকার এ সব দেখুক।”
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বামনেতারা প্রথমেই যান পুইন গ্রামে। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরের দিনই তৃণমূলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে ঘরছাড়া হন ওই গ্রামের সিপিএম কর্মী আয়ুব আলি। তাঁর ভাঙচুর হওয়া বাড়িটি পরিদর্শন করেন বিমানবাবুরা। সেই সময়েই আয়ুবের স্ত্রী ফিরদৌসি বেগম বাইরে থেকে এক রাশ ক্ষোভ উগরে দেন। এমনকী, বামনেতাদের প্রতি যে তাঁর আর ভরসা নেই সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “স্বামী ঘরছাড়া। স্বামীকে ঘরে ফেরাতে তৃণমূলকেই ভরসা করছি। আপনারা চলে যান।”
ফিরদৌসির ক্ষোভ নিয়ে পরে বিমানবাবু বলেন, “কী ভয়ঙ্কর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তৃণমূল! ওই মহিলার চোখ-মুখেই তা ফুটে উঠছিল।”
নানা এলাকায় যে ভাবে কর্মী-সমর্থকেরা মার খাচ্ছেন, তা থেকে তাঁদের পরিবারের এই ক্ষোভ স্বাভাবিক বলেই মনে করছে বাম শিবিরের একাংশ। আর সেই কারণেই দলে দলে সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ারও হিড়িক পড়েছে বলে মনে করছেন ওই বামনেতারা। তাঁদের কেউ কেউ এ-ও বলছেন, একে তো নির্বাচনে ভরাডুবির পরে নেতারা আর ভরসা দেওয়ার জায়গায় নেই। তা ছাড়া, তাঁরা আক্রান্ত এলাকায় গেলে ফের কর্মী-সমর্থকদের প্রহৃত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাঁদের প্রশ্ন, বামনেতারা কেন শুধু আক্রান্ত এলাকায় একবার ঘুরে না এসে সরাসরি পুলিশ প্রশাসনের দফতরের সামনে ধর্নায় বসে এ নিয়ে তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করছেন না?
হামলা যে সহজে বন্ধ হবে না এ দিন আরামবাগে যেন তার ইঙ্গিতও পেয়ে গেলেন বিমানবাবুরা। আয়ুবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁরা যান দলের পুইন শাখা কমিটির সম্পাদক মনোরঞ্জন ওরফে হারু রায়ের বাড়িতে। তাঁর বাড়িটিতেও ভাঙচুর এবং লুঠপাট চালানো হয়েছে। হারুও বর্তমানে ঘরছাড়া। কিন্তু সেই বাড়িতে ঢোকার আগে বিমানবাবুদের সামনে এগিয়ে এসে স্থানীয় তৃণমূল নেতা প্রশান্ত দে’কে বলতে শোনা গেল, ‘বছর দশেক আগে যখন আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং লুঠ হচ্ছিল তখন তো আপনাদের দেখা যায়নি’।
বিমানবাবুরা কেউ উত্তর দেননি। হারুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁরা যান দলীয় কর্মী প্রভাত রায়ের পুড়িয়ে দেওয়া পোলট্রি দেখতে। ভস্মীভূত পোলট্রির সামনে বামনেতারা যখন দাঁড়িয়ে, তখন পিছন থেকে ফের প্রশান্তবাবুকে বলতে শোনা যায়, ‘সিপিএম কোনও দিন রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরলে তবেই হারু বাড়ি ফিরতে পারবে’।
এ নিয়ে বিমানবাবু বা ফ্রন্টের কোনও নেতা প্রতিক্রিয়া জানাননি। আরামবাগ শহরে ভাঙচুর হওয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের জোনাল কার্যালয়টি দেখার পরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বামনেতারা জয়সিংহচকের ঢ্যাঙাগাছি এবং ক্ষেত্রপাড়ায় গিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন। দু’টি এলাকার শ’দেড়েক ঘরছাড়া বাম কর্মী-সমর্থক সম্প্রতি ফিরলেও তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। এ দিন নেতারা আসায় তাঁরা কিছুটা ভরসা পেয়েছেন বলে জানান।