হাওড়ার ঘুসুড়ির একটি মণ্ডপে সকালে অঞ্জলির সময়ে মাস্কহীন ভিড় ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
আদালতের নির্দেশ ছিল, বড় পুজোর ক্ষেত্রে ৪৫ জন এবং ছোট পুজোর ক্ষেত্রে ১৫ জনের বেশি লোককে একসঙ্গে অঞ্জলির জন্য মণ্ডপের ভিতরে প্রবেশ করানো যাবে না। যাঁরা অঞ্জলি দিতে মণ্ডপে ঢুকবেন, তাঁদের প্রত্যেকের প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ়ও নেওয়া থাকতে হবে। মাস্ক পরে থাকাটা বাধ্যতামূলক তো বটেই, মণ্ডপের ভিতরে মানতে হবে শারীরিক দূরত্ব-বিধিও। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, অষ্টমীর সকালে এর কোনও নিয়মই মানা হল না পুজো মণ্ডপে। অভিযোগ, অনিয়ম হচ্ছে দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করলেন পুজোকর্তা থেকে পুলিশকর্মীরা।
সেই সুযোগে কোনও মণ্ডপে একসঙ্গে অঞ্জলি দিলেন ৭০-৮০ জন, কোথাও আবার দিনের শেষে মোট অঞ্জলি দেওয়া লোকের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৭০০! মন্ত্রপাঠ শুরু হওয়ার পরে প্রায় কোথাওই মাস্ক পরে থাকার বালাই ছিল না। দেখা যায়নি শারীরিক দূরত্ব-বিধি পালনের ন্যূনতম দায়িত্ববোধটুকুও। এর সঙ্গেই অঞ্জলির পরে বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত হয়েছে ভোগ খাওয়ার আসর। সেই খাওয়ার লাইনের ভিড় দেখে বোঝার কোনও উপায় ছিল না যে, কিছু দিন আগেও এক ভয়াবহ অতিমারির সঙ্গে লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছে এই শহর। যে অতিমারি এখনও পিছু ছাড়েনি আমাদের। অভিযোগ, প্রায় কোথাও কারও কাছেই দেখতে চাওয়া হয়নি প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ়ের শংসাপত্র। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বালিগঞ্জ কালচারালের পুজোকর্তা অঞ্জন উকিল বললেন, ‘‘আমাদের মণ্ডপে এ দিন ২০০ জনেরও বেশি মানুষ অঞ্জলি দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিষেধকের দু’টি ডোজ়ের শংসাপত্র সত্যিই দেখতে চাওয়া যায়নি। এত লোকের থেকে এ ভাবে শংসাপত্র দেখা কি সম্ভব?’’ একই রকম দাবি একডালিয়া এভারগ্রিন, চেতলা অগ্রণী বা সুরুচি সঙ্ঘের মতো পুজোগুলির। চেতলা অগ্রণীর পুজোকর্তা সমীর ঘোষ বললেন, ‘‘মণ্ডপে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলেই যা উত্তেজনার পরিস্থিতি, অঞ্জলি নিয়ে কিছু বললে লোকে মারতে আসত।’’
কুমোরটুলি সর্বজনীনের পুজোকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য আবার বললেন, ‘‘পাঁচশোরও বেশি মানুষ আমাদের মণ্ডপে এ দিন অঞ্জলি দিয়েছেন। গঙ্গাস্নান সেরে দূর-দূরান্তের বহু মানুষ অঞ্জলি দিতে এসেছেন। কাকে ছেড়ে কার থেকে শংসাপত্র চাইব?’’ একই দাবি কাশী বোস লেনের পুজোকর্তা সৌমেন দত্তেরও। ভিড়ের আতঙ্ক বাড়িয়ে শোরগোল ফেলে দেওয়া শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোকর্তা দিব্যেন্দু গোস্বামীরও দাবি, ‘‘সকাল সাতটা থেকে শুরু হওয়া অঞ্জলি বিকেল তিনটের পরেও চলেছে। এত বেশি লোক যে, ওই ৪৫ জন করে ঢোকানোর নিয়ম ধরে রাখা যায়নি। কখনও ৬০ জনের বেশি, কখনও আবার ৭০ জনের বেশি লোকও হয়েছে। তবে করোনার জন্য এ বার বসে ভোগ খাওয়ানো বন্ধ রেখেছি আমরা।’’ বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনীর কর্তা গৌতম নিয়োগী আবার বললেন, ‘‘এই জটিলতার কারণেই নিয়মভঙ্গ হতে পারে ভেবে অঞ্জলি বন্ধ রেখেছি আমরা। কিন্তু তাতেও ভিড়ের চাপ সামলে উঠতে পারিনি।’’
তবে শুধু অঞ্জলিতেই নয়, লাগামছাড়া ভিড় দেখা গিয়েছে অষ্টমীর সারা দিনই। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, এক সময়ে যান চলাচল প্রায় থমকে যায় ভিআইপি রোড, ইএম বাইপাস, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ এবং এ জে সি বসু রোডে। একই রকম অবস্থা হয় রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, কসবা কানেক্টরের কাছেও।
গার্ডরেল দিয়ে পৃথক লেন তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পুলিশি বন্দোবস্তও কাজে লাগেনি। ভিড় কমাতে পারেনি শ্রীভূমির মণ্ডপে লেজ়ার শো বন্ধ করার পদক্ষেপও। রাত যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে বেপরোয়া জনতার ভিড়।
দেশপ্রিয় পার্কের পুজোকর্তা সুদীপ্ত কুমারের মন্তব্য, ‘‘রাত তিনটেতেও বানের জলের মতো লোক ঢুকেছে। করোনার কী হবে, জানি না। আগামী দু’দিন বৃষ্টি বাধা না হলেই হল।’’ চিকিৎসকদের বড় অংশই বলছেন, ‘‘যেমন খুশি নিয়মে পুজো চলছে। দিন পনেরোর মধ্যেই সংক্রমণ বাড়ার ফলাফল হাতের কাছে চলে এলে এই ভিড়ের দায় কে নেবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে থেকে যাবে।’’