সমীক্ষার কাজ শুরু ডেউচায়। ছবি: পাপাই বাগদি।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এখন ‘শো-কেস’ প্রকল্প হিসাবে সবার আগে এই নামটি রয়েছে। কিন্তু বীরভূমের সেই ডেউচা-পাঁচামির প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্পেও বিঁধেছে আন্দোলন কাঁটা। সে কাঁটা কতটা তোলা সম্ভব হয়েছে? জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে চাকরি এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও কি হয়েছে? জেলার প্রশাসনিক শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। সে কথা মাথায় রেখেই এলাকার মানুষের (বিশেষ করে আদিবাসী) সঙ্গে লাগাতার আলোচনা করে তাঁদের আস্থা অর্জন করার ফলেই খনির কাজে গতি এসেছে। তাঁদের দাবি, মানুষ এগিয়ে এসে জমি দিচ্ছেন সরকারকে। জমিদাতা পরিবারের সদস্যেরা চাকরির নিয়োগপত্রও পাচ্ছেন।
প্রকল্প যেখানে দাঁড়িয়ে প্রায় ২০ বছর আগে জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাথমিক সমীক্ষায় উঠে আসে, মহম্মদবাজার ব্লকের ওই তল্লাটে ১০টি মৌজায় মাটির নীচে ২১০ কোটি টন উন্নতমানের কয়লা সঞ্চিত রয়েছে। এই কয়লা তোলা গেলে বীরভূম তো বটেই, রাজ্যও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিরাট লাভবান হবে।
কিন্তু মাটির তলায় কোন স্তরে, কত কয়লা জমা আছে, তা উপর থেকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই ডেউচা-পাঁচামি ও দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা ‘কোল ব্লকে’ কোথায়, কত পরিমাণ কয়লা কী অবস্থায় আছে, তা জানতে তথ্যভিত্তিক সমীক্ষা চালানো জরুরি ছিল। ডেউচায় কয়লা খনি গড়ার ‘নোডাল এজেন্সি’ পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের (পিডিসিএল) হয়ে এই সমীক্ষা চালানোর দায়িত্বে রয়েছে ‘সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট’ (সিএমপিডিআই)। প্রকৃত চিত্র পেতে প্রস্তাবিত এলাকায় মোট ৭৯টি জায়গায় ড্রিল বা বোর হোল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যার থেকে জানা যাবে, মাটির কত নীচে কয়লা আছে এবং কয়লা তোলার পদ্ধতি কী হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা এলাকায় ১৪টি এবং ডেউচা-পাঁচামি ব্লকে ৩৫টি ‘বোর হোল’ সম্পন্ন হয়েছে। ডেউচায় ১৭টি বোর হোল করার কাজ চলছে। প্রশাসনের বক্তব্য, এই কাজে এখন আর বিশেষ বাধা আসছে না। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মানুষ কাজে সহায়তা করছেন।
বাধা পার
প্রধানত দু’টি বাধা ছিল এই কাজে। এক, এলাকায় বসবাসকারী মানুষের একাংশের বিরোধিতা। দুই, প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জুড়ে প্রস্তাবিত খনি এলাকায় বসবাসকারী প্রকৃত জমির মালিক, বর্গাদার পাট্টাদার ভূমিহীনদের চিহ্নিত করা এবং জমির রেকর্ড ঠিক করা। প্রথম পর্যায়ে যে অংশে খনির কাজ শুরু হবে (দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা), সেখানে প্রাথমিক ভাবে এই সংক্রান্ত কাজ শেষ। দ্বিতীয় অংশে (ডেউচা-পাঁচামি) জমির রেকর্ড ঠিক করার কাজ চলছে। আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম অংশে ভূমিহীনদের পাট্টা দেওয়া হয়েছে।
সরকার পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করার পর থেকেই এলাকায় আন্দোলনে নামে ‘বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’। প্রশাসনের অভিযোগ, ‘বহিরাগত ও স্বার্থান্বেষী’ কিছু মানুষ আন্দোলনে ইচ্ছাকৃত ভাবে ইন্ধন দিচ্ছেন। কিন্তু, সকলেই খনির বিপক্ষে নয়। তাই স্থানীয়দের আস্থা অর্জনে লাগাতার প্রয়াস চালানো হয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের। তাতে অনেকেই সরকারি শর্ত মেনে জমি দিতে রাজি হয়েছেন বলেও দাবি করা হচ্ছে। যদিও আন্দোলনকারীরা প্রশাসনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
কেন্দ্রপাহাড়ি গ্রামের উদাহরণ দিচ্ছে প্রশাসন। এই গ্রাম থেকেই সমীক্ষার জন্য প্রথম খননের কাজ শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রপাহাড়ি গ্রামে বসবাস কমবেশি ২১৫টি পরিবারের। অধিকাংশ পরিবারই খনির জন্য জমি দিতে সম্মতি জানিয়েছে বলে প্রশাসনের দাবি। বেশ কয়েক জন তাঁদের জমি সরকারকে রেজিস্ট্রিও করে দিয়েছেন। জুনিয়র কনস্টেবল পদে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন অনেকে। খননের কাজে বাধাও আসেনি।
খনি-এলাকার মানুষের আস্থা অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে তিন দফায় প্রায় সাড়ে পাঁচশো জমিদাতা পরিবার মনোনীত সদস্যদের সরকারি চাকরি দেওয়া। প্রশাসন সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ৫১৬ জনকে চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৩৮ জন পেয়েছেন গ্রুপ ডি-র নিয়োগ। বাকিরা জুনিয়র কনস্টেবল পদে।
তা হলে কি খনি বিরোধী আন্দোলন এখন স্তিমিত?