ফাইল চিত্র।
ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণের বোঝা আসলে কতখানি, তা খোলসা করতে রাজ্যগুলিকে আরও তিন বছর সময় দেবে কেন্দ্র। এতে পশ্চিমবঙ্গের মতো যে সমস্ত রাজ্যের ঋণের বোঝা অনেক বেশি, তারা স্বস্তিও পাবে কিছুটা। কিন্তু তা বলে সেই ভরসায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে খুব দ্রুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ঋণের বোঝা কমাতে হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। একই মত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কেরও।
অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (স্টেট জিডিপি বা এসজিডিপি) ৩৪.২ শতাংশ। তার উপরে লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, কৃষক-বন্ধু, রূপশ্রীর মতো এক গুচ্ছ প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দের দৌলতে রাজ্যের নিজস্ব কর বাবদ আয়ের প্রায় সিকি ভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সতর্ক না হলে, ২০২৬-২৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের ঋণের ভার রাজ্যের জিডিপি-র ৩৭ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে সাবধান করছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কই।’’
ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণের বোঝা কমিয়ে দেখাতে অনেক রাজ্যই বাজেটের বাইরে ঋণ নিচ্ছে। এক মাস আগে ধর্মশালায় মুখ্যসচিবদের বৈঠকে কেন্দ্র এ বিষয়ে রাজ্যগুলিকে সতর্ক করেছে। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, কোভিডের ধাক্কায় সব রাজ্যেরই রাজস্ব আদায় কমেছে। বেড়েছে খরচ। ফলে রাজ্যগুলিকে আরও বেশি ধার করতে হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু রাজ্য বাজেটের খাতায় ঋণের পরিমাণ এবং ঘাটতি কম করে দেখাতে বাজেটের বাইরেও ঋণ নিচ্ছে। কোনও রাজ্য হাসপাতাল বা সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিচ্ছে, তো কোনও রাজ্য আবার বকেয়া রেখে দিচ্ছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার পাওনা।
অর্থ মন্ত্রকের এত দিনের অবস্থান ছিল, চলতি বছরেই এই সমস্ত ঋণকে বাজেটের হিসাবের খাতায় নিয়ে আসতে হবে। যাতে রাজ্যের রাজকোষের আসল ছবি স্পষ্ট বোঝা যায়। এ বার নর্থ ব্লক জানিয়েছে, ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সময় দেওয়া হবে। কিন্তু একই সঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যকে তার আগেই ঋণের বোঝা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
কেন এই জরুরি বার্তা? অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি রাজ্যগুলির রাজকোষের হাল যাচাই করে কোন রাজ্য কতখানি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে, তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তা অনুযায়ী, যে দশটি রাজ্যের জিডিপি-র অনুপাতে ঋণের হার সব থেকে বেশি, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে। এই দশটির মধ্যে আবার যে পাঁচটি রাজ্যের অবস্থা সব থেকে করুণ, তার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন রাজ্যগুলির ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিল। ২০২০-২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সেই ঊর্ধ্বসীমা টপকে ঋণ নিয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের ঋণ ও রাজকোষ ঘাটতি, দুই-ই অর্থ কমিশনের লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি হবে বলে অনুমান।
ধর্মশালার বৈঠকে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা রাজ্যগুলিকে নিত্যনতুন নগদ অর্থ বিলি প্রকল্প ঘোষণার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। রাজ্যগুলিকে সতর্ক করতে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া অবস্থার উদাহরণও টানা হয়। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের চারটি নতুন নগদ বিলি প্রকল্পকে চিহ্নিত করেছে। লক্ষ্মীর ভান্ডার, কৃষক-বন্ধু, কন্যাশ্রী ও রূপশ্রী। রাজ্যের মোট রাজস্ব আয়ের ৯.৫ শতাংশই এই সব নগদ বিলি বা ভর্তুকিতে খরচ হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের নিজস্ব কর বাবদ আয়ের ২৩.৮ শতাংশ খরচ হচ্ছে এ সবে। উল্লেখ্য, কোভিড-বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ জোগানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন অনেক প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ। কিন্তু একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে ঘাটতি মাত্রাছাড়া হওয়া রুখতে রাজকোষে আয় বৃদ্ধিতেও জোর দিয়েছেন তাঁরা।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মোট খরচের ৯০ শতাংশের বেশি অর্থ বেতন, পেনশন, নগদ বিলি, পুরো ঋণের সুদ মেটাতে খরচ হয়। ফলে নতুন পরিকাঠামো তৈরিতে খরচের জন্য অর্থ থাকে না। রাজস্ব খাতে খরচের মধ্যেও ৩৫ শতাংশের বেশি খরচ হয় পেনশন, পুরনো ঋণের সুদ ও প্রশাসনিক খরচ মেটাতে। এই সব খরচ কমানোর উপায় নেই। ফলে উন্নয়নে খরচের জন্য অর্থ হাতে থাকছে না। পরিস্থিতি শোধরানোর জন্য পদক্ষেপ ছাড়া উপায় নেই।’’