পাহাড়ের নেশায় হিমালয়ের কোলে ভিড় জমিয়েছেন অভিযাত্রীরা। আট হাজারি শৃঙ্গের চুড়ো ছুঁয়ে আসতে দেশি-বিদেশি বহু পর্বতারোহী এখনও ‘ঠিক সময়ের’ অপেক্ষায়। অনেকে আবার ইতিমধ্যেই শৃঙ্গারোহণ বা ‘সামিট’-এর সাফল্য চেখে ফেলেছেন। কিন্তু এ বছরে সেই সঙ্গে মৃত্যু এবং নিখোঁজের ঘটনাও ঘটছে পাল্লা দিয়ে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে এভারেস্ট, মাকালু থেকে চো ইউ- ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি প্রাণহানির খবর এসেছে। গত বুধবার কাঞ্চনজঙ্ঘায় মৃত্যু হয়েছে বাঙালি আরোহী কুন্তল কাঁড়ার ও বিপ্লব বৈদ্যের। নিখোঁজ এক চিলে অভিযাত্রী। বৃহস্পতিবার মাকালু থেকে পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষ নিখোঁজ, মৃত্যু এক ভারতীয় ফৌজি আরোহীর। সাউথ রুট দিয়ে এভারেস্টের ‘সামিট’ পথ খোলার পরেই মারা গিয়েছেন ভারতীয় আরোহী রবি ঠক্কর।
কেন বাড়ছে মৃত্যুর হার? দীপঙ্করের মতো অভিজ্ঞ পর্বতারোহীও কেন বিপদে পড়ছেন? পর্বতারোহী মহলের একাংশ এর জন্য দায়ী করছে আবহাওয়াকেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা বা এভারেস্টের ক্যাম্পে বসে ঘূর্ণিঝড় ফণীর দাপট ভাল ভাবে টের পেয়েছিলেন অভিযাত্রীরা। দুর্যোগ এতটাই বেশি ছিল যে, হাওয়ার দাপটে তাঁবু প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। ফণী শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বার বার বিভিন্ন শৃঙ্গে খারাপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হন অভিযাত্রীরা। এমনকি, এর সৌজন্যে এখনও পর্যন্ত চিনের দিক থেকে এভারেস্ট সামিটের পথ খুলতে পারেননি শেরপারা। ফলে অভিযান বাতিল করে ইতিমধ্যেই বাড়ির পথ ধরেছেন ওই রুট দিয়ে অভিযান করতে আসা বেশ কিছু পর্বতারোহী।
সাধারণত, মাটির ১২-১৪ কিলোমিটার উপর দিয়ে নদীর মতো বয়ে চলা বায়ু 'জেট স্ট্রিম', বর্ষা আর স্থানীয় উল্লম্ব বায়ুর উপরে এই সময়ে হিমালয়ের আবহাওয়া কেমন থাকবে তা অনেকটা নির্ভর করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক লক্ষ্মীনারায়ণ শতপথীর ব্যাখ্যায়, হিমালয়ের উপর দিয়ে সারা বছরই আঁকাবাঁকা পথ ধরে বইতে থাকে এই জেট স্ট্রিম। কিন্তু গরমকালে বেশি তাপের কারণে বায়ুমণ্ডলের উচ্চচাপ অঞ্চলটি উপরে আর উত্তরের দিকে সরে যায়। এর ফলে জেট স্ট্রিম হিমালয়ের উপরে দুর্বল হয়ে পড়ে। একে বলে ‘স্প্রিং উইন্ডো’। এটাই হল শৃঙ্গ আরোহণের প্রশস্ত সময়। তবে কি আট হাজারি শৃঙ্গগুলিতে খারাপ আবহাওয়ার জন্য জেট স্ট্রিমই দায়ী? লক্ষ্মীনারায়ণ বলছেন, ‘‘সেটা এই ভাবে বলা ঠিক হবে না। এটা এখনও গবেষণার স্তরে আছে। তবে এক একটা শৃঙ্গে এক এক রকম আবহাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে স্থানীয় উল্লম্ব বায়ুর উপরে। অনেক সময়ে এর জন্য একই শৃঙ্গের ভিন্ন রুটে আলাদা রকম আবহাওয়া হতে পারে।’’
এর জন্যই ভিন্ন শৃঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের দিকে চেয়ে থাকেন অভিযাত্রীরা। কিন্তু বাস্তব হল, এভারেস্ট ছাড়া আর কোনও আট হাজারি শৃঙ্গের পূর্বাভাস সে ভাবে মেলে না। যে কাঞ্চনজঙ্ঘার আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে বদলায়, সেখানেও অভিযানে গিয়ে তাই ওয়েদার উইন্ডো (যে সময়ের মধ্যে সামিট করে ফিরে আসতে হবে) খুঁজতে নাজেহাল হতে হয় রুদ্রপ্রসাদ হালদার-রমেশ রায়দের। রুদ্রপ্রসাদের কথায়, ‘‘এভারেস্টের নাম বেশি, লোকের চাপ বেশি, তাই ওখানকার ঠিকঠাক পূর্বাভাসের ব্যবস্থা আছে। অন্য শৃঙ্গগুলোতে তা নেই। তাই সেখানে গিয়ে বিপদে পড়ছেন অভিযাত্রীরা।’’ সে ক্ষেত্রে বেশি উচ্চতায় বেশি হাওয়ার মুখে পড়ে শরীরের জল দ্রুত হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে ‘হাইপোথার্মিয়া’ হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।
নেপাল সরকারের পর্যটন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর ছোট-বড় মিলিয়ে নেপালের ২০টি শৃঙ্গে পা রাখছেন প্রায় ৭০০ অভিযাত্রী। শুধু এভারেস্টেই সামিট করতে সেখানে হাজির প্রায় ৩৭০ জন পর্বতারোহী। এই সংখ্যাটা গত বছরের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ফলে বাড়ছে সমস্যা। কী রকম?
সপ্তশৃঙ্গজয়ী সত্যরূপ সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ, এর ফলে সামিটের রাস্তায় ট্র্যাফিক জামের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে তুষারক্ষত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। ‘ওয়েদার উইন্ডো’ কম থাকলে এই ঝুঁকিগুলো আরও বেড়ে যায়। কারণ সে ক্ষেত্রে অল্প দিনের মধ্যে বেশি অভিযাত্রী সামিটে যাওয়ায় ‘ট্র্যাফিক জ্যাম’ অনিবার্য।
দুর্গম কাঞ্চনজঙ্ঘায় অভিযান চালাতে গিয়ে এই সমস্যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন বাঙালি আরোহীরা। রুদ্রপ্রসাদ বলছেন, ‘‘বুধবার কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক সঙ্গে এত লোক চড়েছে, সেটা একটা রেকর্ড। কিন্তু তাতে সামিটের কাছে গিয়ে ট্র্যাফিক জ্যামে পড়তে হয় আমাদের। একটা উঁচু মতো জায়গা আছে, যেটা পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে তবে সামিট। আধ-এক ঘণ্টার রাস্তা। লোক বেশি থাকায় সেটাই পেরোতে লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। ফেরার সময় দেড় ঘণ্টা। এতটা বেশি সময় লাগায় আমার অক্সিজেনও আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।’’
এ ছাড়া, পর্বতারোহণ সংস্থাগুলির আশ্বাসের উপরে ভর করে পাহাড় চড়তে যাওয়া, অক্সিজেন-শেরপা ছাড়া সামিট করে নজর কাড়ার চেষ্টা, কষ্টে জোগাড় করা স্পনসরদের কাছে মুখরক্ষায় সফল হওয়ার চাপ—এ সব তো রয়েইছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে দক্ষ শেরপার অভাবও। রুদ্রপ্রসাদের কথায়, ‘‘বেশি লোক পাহাড়ে আসছে মানে, বেশি লোক শেরপা পেশাতেও আসছে। কিন্তু তাতে দক্ষ শেরপাদের সংখ্যা কমছে। যা বিপদ বাড়াচ্ছে অনভিজ্ঞ অভিযাত্রীদের।’’