কফিনে পরেশচন্দ্র নাথ। শুক্রবার দুর্গাপুরে। —নিজস্ব চিত্র।
অবশেষে ঘরে ফিরলেন পরেশচন্দ্র নাথ। তবে, কফিনে। পাহাড়ই প্রাণ কাড়ল এই পাহাড়-প্রেমীর।
এই এক বছর দুর্গাপুরের পর্বতারোহীর দেহ ছিল প্রায় আট হাজার মিটার উঁচু সাউথ কলে। তাঁর কফিনবন্দি দেহ বৃহস্পতিবার বিকেলে কাঠমান্ডু থেকে বিমানে দমদমে আসে। গভীর রাতে তা পৌঁছয় দুর্গাপুরে। ডিএসপি হাসপাতালের মর্গ থেকে শুক্রবার সকালে ৫৮ বছরের পর্বতারোহীর দেহ আনা হয় বাড়িতে।
গত বছর এভারেস্ট অভিযানে বেরিয়ে নিখোঁজ হন প্রতিবন্ধী পরেশবাবু। বারো বছর বয়সে দীপাবলির বাজি ফাটাতে গিয়ে উড়ে গিয়েছিল বাঁ হাতের কব্জির নীচের অংশ। তবু দমেননি। পহেলগাঁওয়ের জওহর ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহণের প্রথম পাঠ। দার্জিলিংয়ের এইচএমআই থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে হিমাচল প্রদেশের সিটিধর (৫,২৯৪ মিটার) শৃঙ্গে আরোহণ করেন। এর পর ৭ হাজার মিটারের কম উচ্চতা বিশিষ্ট হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গে তিনি প্রায় ৩০ বার অভিযানে গিয়েছিলেন।
২০১৪ ও ২০১৫ সালে দু-দু’বার এভারেস্ট অভিযানে বেরিয়েও প্রাকৃতিক কারণে বেস ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করার জেদ থেকে সরেননি। ধারদেনা করে গত বছর ফের অভিযানে বেরোন পরেশবাবু। সেখানেই ঘটে বিপর্যয়। তিন দিনের বেশি নিখোঁজ থাকায় পরেশবাবু এবং ব্যারাকপুরের পর্বতারোহী গৌতম ঘোষকে মৃত ঘোষণা করে নেপাল সরকার।
দিন কয়েকের মধ্যেই পরেশবাবুর দেহের হদিস মেলে। কিন্তু, খারাপ আবহাওয়ার জন্য দেহ নামানো যায়নি। এ বছর রাজ্য সরকার দেহ নামাতে সক্রিয় হয়। যুবকল্যাণ দফতরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি সৈয়দ আহমেদ বাবা, পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা দেবদাস নন্দী এবং প্রাক্তন উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায় বেস ক্যাম্প অবধি যান। দেবদাস বলেন, ‘‘ওই উচ্চতায় এক বছর দেহ পড়ে থাকার পর তা কী অবস্থায় মিলবে, আদৌ মিলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল।’’ তিনি জানান, শৃঙ্গের নীচে ট্র্যাঙ্গুলার ফেসে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল গৌতমের দেহ। সাউথ কলের ৪ নম্বর ক্যাম্পে ‘প্যাক’ করে রাখা ছিল পরেশবাবুর দেহ। যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ওঁরা যে ভাবে উদ্যোগী হয়ে দেহ নামিয়ে আনলেন, তা প্রশংসনীয়।’’
এ দিন সকালে ডিএসপি হাসপাতাল থেকে পরেশবাবুর দেহ ডিএসপি টাউনশিপের বি-জোনে শরৎচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে পৌঁছতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী সবিতা নাথ। পাশে তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে তাঁদের ছেলে, পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া অদ্রিশিখর। পরিবারের সুহৃদ মধুমিতা গুহ সামলে রাখছিলেন সবিতাদেবীকে। বীরভানপুর শ্মশানে শেষকৃত্য সারা হয়।
এভারেস্ট অভিযানে বেরনোর সময় পরেশবাবুর হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক শঙ্খ সাঁতরা। এ দিন মরদেহে মালা দিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এমন দিন দেখতে হবে ভাবিনি!’’ দুর্গাপুর মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সাগরময় চৌধুরীর কথায়, ‘‘কত প্রতিকূলতা জয় করে পরেশ বেরিয়েছিলেন এভারেস্ট জয়ে। উনি চিরদিন দুর্গাপুরবাসীর গর্ব হয়ে থাকবেন।’’