গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রবিবার বিকেলে ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকা। সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গিয়েছিল, কয়েক মিনিটের ঝড়ের অভিঘাত কতটা সাংঘাতিক! পাঁচ জনের মৃত্যু, কয়েকশো জখম, তাঁদের মধ্যে অনেকে আশঙ্কাজনক।
ঘটনাচক্রে, রাজ্যে প্রথম দফার ভোট আগামী ১৯ এপ্রিল। যে তিনটি আসনে ভোট, তার মধ্যে জলপাইগুড়ি অন্যতম। ফলে প্রত্যাশিত ভাবেই রাজনৈতিক শিবিরে তৎপরতা তুঙ্গে। রবিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত যুযুধান দুই শিবিরের নেতারা গিয়েছেন জলপাইগুড়িতে। তবে সকলের আগে পৈঁছে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ ভাবেও মমতা চির দিনই সশরীরে মানুষের পাশে থেকেছেন। সে ভোট হোক বা না-হোক। ফলে রবিবার রাতে তিনি দ্রুত পৌঁছে যান জলপাইগুড়িতে। রাত প্রায় আড়াইটে পর্যন্ত দুর্গত মানুষের সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলেন। যান হাসপাতালেও।
মমতা যখন জলপাইগুড়ি পৌঁছেছেন, তখন এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে দুর্যোগধস্ত জলপাইগুড়ির মানুষকে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে বিজেপির কোনও প্রথম সারির নেতা রাতেই সেখানে পৌঁছতে পারেননি। সোমবার দুপুরে পৌঁছেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার খানিক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে ফোন করে ফোন করে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রবিবার রাতে মোদী বিজেপি কর্মীদের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সোমবার শাহও এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে দলীয় কর্মীদের বলেন যথাসম্ভব দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। উল্লেখ্য, শাহ পোস্টটি করেছেন বাংলায় ভাষায়। বাংলা হরফে।
অনেকেরই বক্তব্য, এ সবই আসন্ন লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে। এটি আসলে ঝড়-রাজনীতি। এই ঝড়ের কাছেই রাখা আছে ভোটের ঠিকানা!
রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যাশিত ভাবেই দাবি করেছে, ভোট না থাকলেও তারা একই ভাবে ‘তৎপর’ হত। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সোমবার বলেন, ‘‘অন্যেরা কী করত বলতে পারব না, তবে মমতা’দি চিরকালই এটা করে এসেছেন। সেই কারণেই তিনি জননেত্রী।’’ উদাহরণ দিয়ে কুণাল বলেন, ‘‘২০১১ সালে ভবানীপুর উপনির্বাচনের সময়ে কালিম্পংয়ে ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রচার ফেলে প্রার্থী মমতা’দি সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন।’’ তৃণমূলের অন্যান্য নেতারও বক্তব্য, কোনও ঘটনা ঘটলে অব্যবহিত পরেই অকুস্থলে পৌঁছে যাওয়া মমতার সহজাত। সেটি তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সম্প্রতি বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনার পরের সকালেই মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েও গার্ডেনরিচে পৌঁছে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে তিনি যে ঝড়-বিধ্বস্ত মানুষের কাছে যাবেন, তা একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ।
বস্তুত, মমতা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপাতত তিনি জলপাইগুড়িতেই থেকে যাবেন। সোমবার জলপাইগুড়ি পৈঁছেছেন তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রবিবার রাতভর তাঁর ক্যামাক স্ট্রিটের অফিস থেকেও পৃথক ভাবে উদ্ধার ও ত্রাণের কাজের তদারকি হয়েছে। দলের গোটা সংগঠনকে দুর্গতদের সাহায্যার্থে নেমে পড়ার নির্দেশ দেন অভিষেক।
বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বাংলায় বিজেপি যখন ১ শতাংশের পার্টি ছিল, তখনও আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াতাম। আমাদের পারিবারিক সংগঠন এই ধরনের দুর্যোগের পর চিরকাল মানুষের পাশে থেকেছে। ভোট দেখা হয়নি।’’ আবার সিপিএম নেতা তথা দমদম লোকসভার প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘এখনও সারা বছর সবচেয়ে বেশি রক্তদান শিবির করে আমাদের ছাত্র-যুব সংগঠন। আমপান, যশের পরে যখন তৃণমূল ত্রাণের ত্রিপল লুট করেছিল, তখন বামপন্থীরা ত্রাণ সংগ্রহ করে সেখানে পৌঁছে দিয়েছিল। ভোট দেখে বাকিরা করতে পারে, বামপন্থীরা করে না।’’
রবিবার বিকেলে নদিয়ার ধুবুলিয়া থেকে সভা সেরে কলকাতায় ফিরেছিলেন মমতা। কিন্তু জলপাইগুড়িতে দুর্যোগের খবর পাওয়ামাত্রই তিনি আর দেরি করেননি। রাজ্য সরকারের চার্টার্ড বিমানে বাগডোগরা পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে নেমে প্রথমেই মমতা চলে যান জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে। জখমদের সঙ্গে কথা বলেন। তার পরে যান নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। রাত আড়াইটে পর্যন্ত ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’-তে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধারকাজে তদারকি করেন মমতা। প্রসঙ্গত, রবিবার রাতে হাসপাতাল গিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির সিপিএম প্রার্থী দেবরাজ বর্মণও।
অন্য দিকে, মঙ্গলবার সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের আগে জলপাইগুড়িতে পৌঁছন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। পৌঁছন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। কিন্তু তত ক্ষণে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা পুরো এলাকা চষে ফেলেছেন। দুর্গতদের পাশে সশরীরে থেকে, নিহতদের পরিবারবর্গ এবং আহতদের ক্ষতিপূরণের কথা বলেছেন। এবং তা-ও বলেছেন নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধি মেনেই।
রবিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী মোদী পোস্ট করলেও বিজেপির কোনও বড় মাপের নেতা ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেননি। সোমবার শুভেন্দু যুক্তি দিয়েছেন, তৃণমূলের কাছে চার্টার্ড ফ্লাইট রয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের টাকা রয়েছে। তাই মমতা রাতে পৌঁছেছেন। শুভেন্দুর ওই যুক্তি মেনে নিয়েও রাজ্য বিজেপির অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে শুভেন্দুর দল বিজেপি। পাশাপাশিই, অনেকের এ-ও প্রশ্ন যে, রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার রাতে ঘটনাস্থলে গেলেন না কেন? সুকান্ত উত্তবঙ্গেই বালুরঘাটের প্রার্থী। রবিবার তিনি সেখানেই ছিলেন। সড়কপথে বালুরঘাট থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়াই যেত।