Cyclone Amphan

শ্মশানে ছুটে প্রাণ রক্ষা সে রাতে! ঘূর্ণির কক্ষপথে ত্রাসের প্রতিধ্বনি

২১ মে যে ভোর দেখল দুই চব্বিশ পরগনা এবং কলকাতা, তার তুলনা কেউ গত ১০০ বছরে খুঁজে পাচ্ছেন না, কেউ ২০০ বছরে।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

বসিরহাট ও স্বরূপনগর শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২০ ২১:৩৯
Share:

এমনই ধ্বংসের ছবি ছবি স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, বসিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র

‘এমন ভয় কখনও পাইনি!’

Advertisement

বছর পাঁচেক আগে এক ভয়ঙ্কর রাত কাটিয়ে উঠে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন শাহবুদ্দিন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী তিনি, ভুবনজোড়া নাম। ভয় পাওয়া তাঁর ধাতে নেই, খানসেনার বিরুদ্ধে সাঙ্ঘাতিক মুক্তিযুদ্ধ লড়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। পরে প্যারিসে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থেকে যান।

২০১৫-র নভেম্বরে সে শহরে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার রাতে শাহবুদ্দিনের মেয়ে চিত্র আটকে পড়েছিলেন গুলিগোলার মাঝে। ওই রকম ভয় কখনও পাননি, পরের সকালে মেয়েকে ফিরে পেয়ে প্যারিস থেকে ফোনে আমাকেই বলেছিলেন শাহবুদ্দিন। তাই শব্দগুলো মাঝে মাঝেই কানে বেজে উঠত, ওই বিধ্বস্ত কণ্ঠস্বর স্মৃতিতে ফিরে আসত শাহবুদ্দিনের কথা মনে পড়লেই। হুবহু ওই শব্দগুলোই নিজের জীবনে কখনও সত্যি হয়ে উঠবে, তা ২০২০-র ২১ মে-র রাতটা দেখার আগে ভাবতে পারিনি। দুঃস্বপ্নেও আসেনি ওই রকম রাত।

Advertisement

২০ মে-র বিকেল থেকে তাণ্ডব দেখাতে শুরু করেছিল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপান (প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন)। মাঝ রাত পেরিয়েও তাণ্ডব চলছিল কোথাও কোথাও। পরের দিন অর্থাৎ ২১ মে যে ভোর দেখল দুই চব্বিশ পরগনা এবং কলকাতা, তার তুলনা কেউ গত ১০০ বছরে খুঁজে পাচ্ছেন না, কেউ ২০০ বছরে।

পূর্ব কলকাতা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘূর্ণিটা। তার পরে রাজারহাট, মিনাখাঁ, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, স্বরূপনগর, গাইঘাটা— এই অক্ষ ধরেই ছুটে গিয়েছিল উন্মত্তের মতো। বিদ্যুৎ, সড়ক এবং টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় পুরোপরি বিপর্যস্ত। অজস্র ঘরবাড়ি ভেঙেছে বলে খবর আসছিল পর দিন সকাল থেকেই। পানীয় জলের জন্য হাহাকার চলছে বলে জানা যাচ্ছিল। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই ক্ষীণ যে, ক্ষয়ক্ষতির গভীরতা তখনও পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল না কলকাতায় বসে।

আরও পড়ুন: আমপানের ধাক্কা সামলাতে এ বার সেনার সাহায্য চাইল রাজ্য

ঘটনাচক্রে সে রাতেই গন্তব্য হয়ে উঠল স্বরূপনগর। ধ্বংসলীলার প্রায় ভরকেন্দ্র যে সব এলাকা, তার অন্যতম। পেশাগত কারণেই উত্তেজনার বোধ তৈরি হয় এই সব ক্ষেত্রে। বসিরহাট, বাদুড়িয়া, স্বরূপনগরের বিভিন্ন এলাকা পুরোপুরি দুর্গম হয়ে রয়েছে বলে খবর আসছিল না, এমন নয়। কিন্তু এমন বিরল ধ্বংসলীলার পরে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা চাক্ষুষ করার টানও অপ্রতিরোধ্য।

রাত ১০টা নাগাদ কলকাতা থেকে গাড়ি রওনা হল স্বরূপনগরের দিকে। যশোহর রোড হয়ে যাওয়া যাবে না, বড় বড় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ রয়েছে— খবর এসেছিল এক শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে। অতএব বারাসতের চাঁপাডালি মোড় থেকে টাকি রোড ধরতে হল। দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা, বসিরহাট হয়ে ইছামতি সেতু পেরিয়ে স্বরূপনগরের দিকে ঢোকা হবে— রুটম্যাপ ছকে নেওয়া হয়েছিল এ ভাবেই। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামীণ উত্তর ২৪ পরগনায় ঢুকতেই আচমকা বদলাতে শুরু করল পরিবেশটা। সম্পূর্ণ নিষ্প্রদীপ, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চার ধার। কানে তালা লাগানো ঝিঁঝিঁর ডাক আর রাস্তার দু’ধারে টইটম্বুর হয়ে থাকা জলা থেকে কোলাব্যাঙের নিরন্তর গোঙানি। একে কৃষ্ণপক্ষ, তায় ভয়াবহ ঘূর্ণির পরের দিনও গোটা আকাশ জুড়ে ঘন কালো, ঠাসা মেঘ। রাস্তার দু’ধারে যেখানে যেখানে ফাঁকা মাঠ, সেখানে বহু দূরে মেঘের নীচের কিনারা জুড়ে ফিনফিনে-চিলতে রেখার মতো মৃদু সাদা আলোর রেশ, দিগন্ত রেখার মতো। তাতেই আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে আকাশটাকে। ভয়াবহতা যখন পুরোপুরি অন্ধকারে থাকে, তখন চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু সুদূর দিগন্তে ওই দুর্বল আলোর আভাস পুরোপুরি চোখের আড়ালে থাকতে দিচ্ছিল না আকাশ জুড়ে মেঘের ভয়াবহ আয়োজনটাকে। সারা ক্ষণ মনে হচ্ছিল, যে কোনও মুহূর্তে প্রবল বৃষ্টি নামবে। সামনের রাস্তা কতটা দুর্গম, তখনও জানা নেই। প্রবল বৃষ্টি নামলে তা আরও কতটা দুর্গমতর হয়ে উঠবে জানা নেই।

আরও পড়ুন: দু’দিনে কি সব কিছু স্বাভাবিক করা সম্ভব? আমপান পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য মমতার

উত্তেজনা আর আশঙ্কায় দুলতে দুলতে সফর কিন্তু এগোচ্ছে তীব্র গতিতে। বেড়াচাঁপা পেরিয়ে বসিরহাটের দিকে ২-৩ কিলোমিটার এগোতেই ধাক্কা শুরু। রাস্তার এক ধার জুড়ে বড় বড় ট্রাকের সারি। কেন দাঁড়িয়ে রয়েছে এত ট্রাক? বসিরহাটের দিকে ঢুকতে পারেনি? তা কী ভাবে সম্ভব? রাত পোহালেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নামবেন বসিরহাটে। গোটা প্রশাসনকে হাজির হতে হবে সেখানে। রাস্তা খোলা থাকবে না, তা কী হয়? নিশ্চয়ই খোলা রয়েছে, হলফ করে বলছেন সে রাতের একমাত্র সফরসঙ্গী তথা গাড়ির ড্রাইভারও। কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে ট্রাকের সারি শেষ হল, কিন্তু রাস্তার এক পাশ থেকে আর এক পাশ পর্যন্ত শুয়ে থাকা প্রকাণ্ড মহীরূহ জানান দিল, ট্রাকগুলো আর এগোতে পারেনি তার কারণেই। যে ভাবে পড়েছিল গাছটা, তাতে তলা দিয়ে ছোট গাড়ি বা পিকআপ ভ্যান বেরিয়ে যাচ্ছে। অতএব এগিয়ে যেতে বাধা নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড গাছটা পেরিয়ে যত এগোচ্ছি, তত যেন দমচাপা হয়ে উঠছে আবহ। রাস্তাটা দেখে আর রাস্তা মনে হচ্ছে না। ঘন অন্ধকারকে যেটুকু চিরতে পারছে হেডলাইট, তাতে রাস্তার দু’ধারে জঙ্গলের চেহারা দেখা দিতে শুরু করেছে। একের পর এক গাছ পড়ে গিয়েছে, একটা আর একটার সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে, কোথাও কোথাও রাস্তার অর্ধেকটা দখল করে নিয়েছে ঘন ডালপালা, কোথাও সে সবের মাঝখান থেকে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে এসেছে হাইটেনশন বিদ্যুতের তার। আর ভাঙা ডালপালা, অজস্র পাতার স্তূপ, থকথকে কাদা মিলেমিশে ঢেকে দিয়েছে গোটা রাস্তাটাকে।

উত্তর ২৪ পরগনার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রয়েছি! এটাই সেই চেনা, ব্যস্ত টাকি রোড! মনেই হচ্ছে না কোনও ভাবে। নিকষ অন্ধকার আর দমচাপা সুনসান আবহ। মনে হচ্ছে যেন কোনও বিপজ্জনক জুরাসিক জঙ্গলের কোনও এক পরিত্যক্ত রাস্তায় ঢুকে পড়েছে গাড়ি। আরও কয়েক কিলোমিটার সে ভাবেই। তার পরে আর এগনোই গেল না। উপড়ে আসা প্রকাণ্ড মহীরূহের আড়ালে রাস্তা হারিয়ে গিয়েছে। গাড়ি ঘোরানোর সময়ে চার পাশে হেডলাইট ঘুরল। কয়েক ঝলকে মনে হল ধ্বংসস্তূপ গিলে খেতে আসছে।

বেড়াচাঁপা পর্যন্ত ফিরতে হল আবার। ডাইনে মোড় নিয়ে বাদুড়িয়ার দিকের রাস্তা ধরতে হল। বাদুড়িয়া পুর এলাকা পেরিয়ে রামচন্দ্রপুর মোড় হয়ে স্বরূপগরের দিকে বাঁক নেওয়া হবে— রুটম্যাপ এ ভাবে বদলে গেল। বাদুড়িয়া ব্লকের ভিতর দিকে যত ঢুকছে গাড়ি, তত বাড়ছে ধ্বংসের ছবি। কলাবাগান, বাঁশবাগান তো বটেই, কোথাও কোথাও আমবাগানও রাস্তার উপরে উপড়ে এসেছে। পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগোতে হয় কোনওক্রমে। আচমকা দেখা দেয় গোটা রাস্তা জুড়ে শুয়ে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি আর তার গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা হাইটেনশন তার। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। হাইটেনশন তারে বিদ্যুৎ রয়েছে কি না, তা-ও নিশ্চিত ভাবে জানা নেই। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর পরিকল্পনা বাতিল করাও খুব কঠিন। অপেক্ষা স্থানীয় কারও দেখা পাওয়ার, দোলাচল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা। বাইকে চড়ে উল্টো দিক থেকে আসা সিভিক ভলান্টিয়ার জানান, তারে আপাতত বিদ্যুৎ নেই, সকালেই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা দেওয়া হয়েছে গোটা এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ। অতএব আবার এগোয় গাড়ি। কিন্তু বাদুড়িয়া পুরসভা পেরিয়ে রামচন্দ্রপুরের রাস্তা ধরতেই আবার বাধা। প্রকাণ্ড গাছ পথ আটকে রেখেছে, সরানোর সুযোগ পায়নি প্রশাসন।

এ বার সাহায্যে এগিয়ে আসে টহলদার পুলিশগাড়ি। ‘‘খোলাপোতা হয়ে বসিরহাট ঢুকুন, তার পর ব্রিজ পেরিয়ে স্বরূপনগরের দিকে যান,’’— বললেন পি সি পার্টির ইনচার্জ। গাড়ি ফের ঘোরে বাদুড়িয়া চৌরাস্তার দিকে। চৌরাস্তা থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে খোলাপোতার রাস্তা। এক কিলোমিটার এগোতেই আবার রাস্তা ডুবে গেল জঙ্গলে।

সাবিত্রী বাইনদের বাড়ি এখনও এমনই আধখোলা। —নিজস্ব চিত্র

হতোদ্যম দশা, হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি। যেন এক ভুলভুলাইয়ায় আটকে গিয়েছি। ধ্বংসস্তূপের চক্রব্যূহে যেন পথ হারিয়ে ফেলেছি— যেন ঢোকার রাস্তা চেনা ছিল, কিন্তু বেরনোর উপায় আর জানা নেই। যে দিকেই যাই অন্ধগলি। নিকষ রাত আরও নিশুতি হচ্ছে। গন্তব্যে পৌঁছনোর আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে।

গাড়িটা ঘোরাচ্ছিলেন ড্রাইভার। পাশে এসে থামল বাদুড়িয়া থানার পি সি পার্টির সেই গাড়িটা। ইনচার্জ বললেন, ‘‘আপনাদের এই রাস্তার কথা তো বলিনি।’’ কিন্তু এটাই তো খোলাপোতার দিকে যাচ্ছে, চৌরাস্তার বোর্ডে তো তা-ই লেখা। পুলিশ জানাল, থানার সামনের রাস্তা ধরে যেতে হবে, একমাত্র ওটাই খোলা।

আবার নতুন আশায় বুক বেঁধে এগনো শুরু হল। সে রাস্তা উপড়ে আসা গাছে পুরোপুরি অবরুদ্ধ নয় বটে। কিন্তু কোথাও ডিঙোতে হচ্ছে শুয়ে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি, কোথাও গাড়িটাকে তুলে দিতে হচ্ছে রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকা বিরাট টিনের চালার উপরে। আর দু’ধারের অন্ধকার চিরে প্রকৃতির সেই রুদ্ররোষের আভাস। প্রচণ্ড আক্রোশে কেউ যেন মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে সব কিছু।

বসিরহাট কলেজের সামনে পৌঁছে মনে হল সভ্যতাতেই রয়েছি, জুরাসিক জঙ্গলে নয়। প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে কলেজের উল্টো দিকের মাঠে হেলিপ্যাড তৈরির কাজ শুরু হয়েছে তড়িঘড়ি। রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে পরের দিন বসিরহাট কলেজে বৈঠকেও বসবেন প্রধানমন্ত্রী। অতএব জেনারেটর চালিয়ে দিয়ে কলেজের অন্দরে সাজ সাজ রব। পুলিশ, প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা-সহ সরকারের বিভিন্ন শাখার পদস্থ কর্তাদের একের পর এক গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দু’ধারে। বুকে ভরসা ফেরে। সব শেষ হয়ে যায়নি।

গন্তব্য পর্যন্ত অবশ্য পৌঁছল না গাড়ি সে রাতে। স্বরূপনগর ব্লকে ঢুকল বটে। কিন্তু শেষ কিছুটা পথ হেঁটেই ঢুকতে হল। ভাঙা গাছের তলা দিয়ে, বাঁশঝাড় ডিঙিয়ে, ছিঁড়ে পড়ে থাকা হাইটেনশন তার হাত দিয়ে তুলে ধরে এবং নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই হাতড়ে হাতড়ে। শুক্রবার ভোরের আলো ফুটতেই স্পষ্ট হল, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের চেহারাটা আসলে কেমন, কলকাতায় বসে তা বোঝাই যাচ্ছিল না। বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলি যোগাযোগ, রাস্তাঘাট ঠিক থাকলে হয়তো ছবিটা অনেক দ্রুত স্পষ্ট হত। কিন্তু সে সব ব্যবস্থা তো নিমেষে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গিয়েছে আমপান। অতএব তাণ্ডবের কক্ষপথে না পৌঁছনো পর্যন্ত আঁচই পাওয়া যাচ্ছিল না, কতটা ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমেছে উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায়।

ঘূর্ণি-তাণ্ডবের স্বরূপনগর সম্ভবত শ্মশানের চেয়েও ভয়াবহ। বিদ্যুৎ নেই, ফোন নেই, রাস্তা নেই, গাছপালা নেই, ঘরবাড়ির মাথায় ছাউনি নেই, খাবার জল নেই। চাষের জমি ভেসে গিয়েছে ইছামতির নোনা জলে। পুকুরে পুকুরে মাছের মড়ক। একের পর এক গাছ ভেঙে পড়ে পুকুরের জল কালো কুচকুচে। খাবি খাচ্ছে মাছ, মরে ভেসে উঠছে। মাঠের ধান মাঠেই শেষ। সব্জি খেত উজাড়। ফলের বাগান নিশ্চিহ্ন। মাথায় হাত ঘরে ঘরে।

ইছামতির নোনাজল ভাসিয়ে দিয়েছে চাষের জমি। —নিজস্ব চিত্র

কিন্তু শ্মশানের চেয়েও ভয়াবহ কেন? সে আখ্যান শোনা যায় সাবিত্রী বাইনের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেই। ইছামতির চরের ধারে শেষ বাড়ি সাবিত্রী বাইনের। বছরের যে সময়ে যেমন কাজ মেলে, তেমনই করেন পরিবার প্রতিপালনের জন্য। ছেলেরা জোয়ান হয়েছেন, ফলে ইটের দেওয়ালটা তুলতে পেরেছিলেন কয়েক বছর আগে। ছাউনি টালি আর টিনের। বুধরাতের ঘূর্ণিতে নিমেষে উড়েছিল টিন। চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে আচমকা খোলা আকাশের নীচে। তাও ওই প্রবল দুর্যোগের মধ্যে। তরুণী পুত্রবধূ আর একরত্তি নাতিকে নিয়ে ইছামতির চরের দিকেই দৌড়ে নেমে গিয়েছিলেন সাবিত্রী। শ্মশানের গায়ে যে কালীমন্দির, সেটার মাথায় ছাদ রয়েছে। বাঁচতে হলে ওখানে ঠাঁই নেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। তাণ্ডব-নিশির বাকিটুকু শ্মশানেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

নদীর চরে শ্মশানের এই মন্দিরই সে রাতে আশ্রয় দিয়েছিল সাবিত্রী বাইনদের। —নিজস্ব চিত্র

উড়ে যাওয়া টিনের খানিকটা খুঁজে এনে ভাঙা ঘরের কিছুটা দু’দিন পরে ঢেকেছে বাইন পরিবার। কিন্তু আতঙ্কের রেশ এখনও চোখেমুখে লেগে। শ্মশান শব্দটা আর ভয়াবহতার দ্যোতনা বহন করছে না তাঁদের জন্য। আরও ভয়াবহ কিছু একটা ছুটে গিয়েছে মাথার উপর দিয়ে। রক্ষা করেছে শ্মশানই।

আঁচ করা যায় না আর। ঘূর্ণি-তাণ্ডবের কক্ষপথ বেয়ে ফিরে আসতে আসতে আঁচ করা যায় না, কবে ছন্দে ফিরবে এই বিস্তীর্ণ এলাকা, আদৌ আগের ছন্দ ফিরবে কি না। মনে শুধু গভীর আতঙ্কের রেশ রেখে যায় ২১ মে-র ভয়াবহ রাত। আর শাহবুদ্দিনের সেই বিধ্বস্ত কণ্ঠের উচ্চারণগুলো প্রতিধ্বনির মতো ঘুরে বেড়ায়— ‘এমন ভয় কখনও পাইনি!’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement