নতজানু: এজলাসে ঢোকার মুখে প্রাক্তন উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহকে প্রণাম অনুগামীর। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন বুধবারই। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বোলপুর আদালতের এসিজেএম অরবিন্দ মিশ্রের এজলাসে রায় ঘোষণার কথাও জানতেন অনেকে।
সকাল থেকেই তা-ই বোলপুর আদালত চত্বরে ভিড় জমিয়েছিলেন তাঁরা। কেউ বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহের প্রাক্তন ছাত্র, কেউ প্রাক্তন সহকর্মী। ‘মাস্টারমশাই’য়ের জন্য সঙ্গে ফল, মিষ্টিও এনেছিলেন কেউ কেউ। চোখের কোণে জল ছিল কয়েক জনের।
আদালতে ঢোকার মুখে চেনা লোকেদের দেখে হাসি ফুটল প্রাক্তন উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহের মুখে। পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই কথা বললেন কয়েক জনের সঙ্গে। গত সপ্তাহে বিশ্বভারতীতে হওয়া একটি আলোচনাসভার উল্লেখ করে বললেন, ‘‘ভাল হয়েছিল অনুষ্ঠানটা।’’
বেলা ১১টা নাগাদ আদালতে নিয়ে আসা হয় মুক্তি দেবকে। এর পরেই প্রাক্তন উপাচার্য, প্রাক্তন কর্মসচিব দিলীপ মুখোপাধ্যায় এবং মুক্তি দেবকে নিয়ে যাওয়া হল এসিজেএম-এর এজলাসে। দু’পাশে দুই পুলিশকর্মী ধরে ধরে নিয়ে গেলেন দিলীপ সিংহকে।
এজলাসে প্রথমেই ডাক পড়ে মুক্তিদেবীর। ‘‘আমি নির্দোষ। তাই আমার কোনও বক্তব্য নেই। তবে আমি একা। মা, স্বামী মারা গিয়েছেন” -- এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রাক্তন উপাচার্য কোনও রকমে হেঁটে বিচারকের কাছে যান। দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না বলে তাঁকে বসতে একটি টুল দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজে নিরীহ। ডায়াবেটিস সহ একাধিক রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি একটি অস্ত্রোপচারও হয়েছে। তাই আমার সাজা যাতে কম হয় সেই আবেদন রাখছি।’’ একই কথা জানান প্রাক্তন কর্মসচিবও।
তাঁদের বক্তব্যের পরে বিশেষ সরকারি আইনজীবী নবকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘বয়সের দিক বিবেচনা করে বিচারক যেন কোনও নমনীয় মনোভাব না দেখান। কারণ এর প্রভাব সমাজের উপরে পড়বে। অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এই ঘটনায় বিশ্বভারতীর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের নামও জড়িয়ে গিয়েছে এঁদের জন্যই।’’ মুক্তি দেবের আইনজীবী সৌরভ রায়চৌধুরী, দিলীপকুমার সিংহের আইনজীবী সৈয়দ মহিউদ্দিন এবং দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের আইনজীবী গৌতম সরকার সাজা কম দেওয়ার আর্জি জানান। এরই মধ্যে আদালত কক্ষে বৈদ্যনাথ সাহা নামে এক ব্যক্তি এসে হাজির হন। তাঁর দাবি, এই মামলা সংক্রান্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম বিজ্ঞপ্তি বের হওয়ার পরে একমাত্র তিনিই আবেদন করেছিলেন। সব ঠিক থাকলে তিনিই চাকরি পেতেন।
সব পক্ষের বক্তব্য শুনে এসিজেএম অরবিন্দ মিশ্র বলেন, ‘‘দুপুর তিনটের পরে মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।’’ সাড়ে তিনটে নাগাদ ১৫ বছর ধরে চলে আসা এই মামলার রায় ঘোষণা করেন অরবিন্দবাবু। তিনজনেরই পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ দেন। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়।
আইনজীবী সৈয়দ মহিউদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হব। দিলীপবাবু ভারতবর্ষের দশ জন দিকপাল গণিতজ্ঞের মধ্যে এক জন। মামলা চলাকালীনও বিশ্বভারতী থেকে তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক আলোচনাসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বভারতী যদি ভাবতো দিলীপবাবুর জন্য কর্তৃপক্ষের বদনাম হয়েছে। তা হলে নিশ্চয়ই এ সব করা হতো না।’’
মামলার রায় ঘোষণার কথা শুনে বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য সুজিতকুমার বসু বলেন, ‘‘কোনও বৈঠক হলেই শুনতাম এক মহিলা নাকি কোনও কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন না, অথচ তিনি নাকি গণিতের অধ্যাপিকা। এক দিন রাগ করেই আধিকারিকদের বলেছিলাম, আপনারা দেখুন না তিনি যখন এখানে পড়ান তাঁর কাগজপত্র তো থাকবে। সেই কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে একাধিক তথ্য মিলতে শুরু করল।’’ উল্লেখ্য সুজিতবাবুর আমলেই এ নিয়ে রুজু হয়েছিল মামলা।