দাওয়াই ১: দল ক্ষমতায় নেই, নেতাও এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই। কিন্তু দল তাঁর জন্য এখনও ফি মাসে খরচ করছে লাখ দেড়েক টাকা। দু’টো গাড়ির খরচ, ফাইফরমাশ খাটার জন্য এক সর্বক্ষণের কর্মী। অথচ সেই নেতা কমরেডদেরও একটা বড় অংশের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন দলেই। অবিলম্বে এমন ব্যক্তিকে সামনের সারি থেকে সরাতে হবে।
দাওয়াই ২: গ্রামে গ্রামে দলের বহু পুরনো সমর্থক ও সাধারণ মানুষের একাংশ চাইছেন, নেতারা আগের মতো নিয়মিত তাঁদের কাছে পৌঁছন, সমস্যার সময়ে তাঁদের পাশে থাকুন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এই ঘাটতি অবিলম্বে কাটিয়ে উঠতে হবে।
দাওয়াই ৩: গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত কোণায় অনেকের কাছেই ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর মতো বিষয়ের আবেদন সীমিত। তাই, সে কথা বলে আন্দোলনের ডাক তাঁদের কাছে অর্থবহ হয় না। তার চেয়ে পানীয় জলের সঙ্কট, সেচের সমস্যা, একশো দিনের কাজে দুর্নীতি, পঞ্চায়েতে
টাকা নয়ছয়, ধান ও আলুর দাম না পাওয়ার মতো স্থানীয় বিষয় নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে গ্রামবাসীদের সামিল করে।
দাওয়াই ৪: সময় নষ্ট না করে এলাকায় এলাকায় নতুন নেতা ও কর্মীদের তৈরি করতে হবে, তুলে আনতে হবে। পুরনো মুখদের একাংশের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়, আবার আর এক দল মাওবাদীদের ভয়ে বসে গিয়েছেন।
জঙ্গলমহলে দলের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে এই সব দাওয়াইয়ের প্রস্তাব সম্প্রতি এসেছে সিপিএমের অন্দর থেকেই। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে দলীয় নেতাদের একাংশ ‘রোগ চিহ্নিতকরণ ও রোগ সারানোর ওষুধের’ কথা লিখিত ভাবে জেলা নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। সেখান থেকে তা জানানো হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বকে।
জঙ্গলমহলের এক প্রবীণ সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘আমরা তৃণমূলের দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে বলব, আবার সেই অভিযোগ করা যায়, এমন কেউ আমাদের দলে এখনও গুরুত্ব পেয়ে যাবেন, সেটা হতে পারে না। গ্রহণযোগ্যতা হারানো লোকদের ছেঁটে ফেলতে হবে।’’
আগামী ২০ ও ২১ মে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানেই দলের জেলা-নেতাদের একাংশের এই সব পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা হবে বলে সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে। নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি হওয়ার পরে প্রতিটি জেলায় দলের নতুন সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করা হবে। সিপিএম সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত দাওয়াইয়ের প্রভাব তিন জেলার নতুন সম্পাদকমণ্ডলী গঠনের সময়ে পড়তেই পারে।
দলের পলিটব্যুরো সদস্য তথা সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘জঙ্গলমহলের তিনটি জেলায় দল ঢেলে সাজা দরকার। সে জন্য নতুন নেতৃত্ব ও নতুন কর্মীদেরও তুলে আনতে হবে। এ জন্য যা যা পদক্ষেপ করার করা হবে।’’ দল ঢেলে সাজাতে গিয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারানোদের কি সরানো হবে? সেলিমের জবাব, ‘‘বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় আনা হবে।’’ তবে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের সন্দেহ, ‘‘প্রস্তাবিত দাওয়াই অনুযায়ী কতটা কী হবে, তা বলা মুশকিল। কিছু বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতা কিন্তু থেকেই গিয়েছে।’’
ওই বিশেষ রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, জঙ্গলমহলে দলের অবস্থা পুরোপুরি প্রতিকূলে, তেমন বলা যাবে না। দাবির পক্ষে জঙ্গলমহলের একটি বিশেষ এলাকায় করা সমীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। ওই এলাকায় দলের শতাধিক কর্মী মাওবাদীদের হাতে নিহত এবং দল সেখানে কোনও পঞ্চায়েতেই ক্ষমতায় নেই।
দল সূত্রের খবর, কয়েক জন বর্ষীয়ান নেতা জঙ্গলমহলের ওই তল্লাটে সপ্তাহখানেক পড়ে থেকে প্রায় এক ডজন পঞ্চায়েতের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছেন, এই অবস্থাতেও প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন ঢলে রয়েছে বামফ্রন্টের দিকে, ৩৮.৫ শতাংশ মানুষ তৃণমূলকে আরও কিছুটা সময় দিতে চান, ১০ শতাংশ মানুষ বিজেপি সম্পর্কে তাঁদের মোহভঙ্গের কথা জানাচ্ছেন, কিন্তু কোন দিকে যাবেন, সেটা ঠিক করে উঠতে পারছেন না। বাকি সাড়ে সাত শতাংশ মানুষ কিছু খোলসা করেননি।
কৃষকসভার এক প্রবীণ নেতার বক্তব্য, ‘‘সমীক্ষা থেকে মনে করার কারণ নেই যে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনেই জঙ্গলমহলে সিপিএমের ক্ষত পূরণ হয়ে যাবে বা দল বিপুল জয়ের মুখ দেখবে। কারণ, তৃণমূলকে খোলাখুলি সমর্থন করার কথা যাঁরা বলছেন না, তাঁদের একটা বড় অংশও বিভিন্ন কারণে শেষ পর্যন্ত সম্ভবত শাসক দলের দিকেই ঝুঁকবেন।’’ তবে চাইলে রক্তক্ষরণ যে আটকানো যেতে পারে, সেই আশা এই সমীক্ষা দেখাচ্ছে বলে ওই নেতার অভিমত। জঙ্গলমহলের পোড় খাওয়া ওই বাম-নেতার কথায়, ‘‘বিজেপি সম্পর্কে যাঁদের মোহভঙ্গ হয়েছে, তাঁদের সমর্থন পাওয়াটা আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দলের পুনরুজ্জীবনের কথা মাথায় রেখে যে সব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কার্যকর না হলে ওই মানুষেরা সমর্থন করবেন কি না, সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন।’’