সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিকে হাতিয়ার করে বিধানসভার মধ্যে জোটে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চালাল তৃণমূল। আর একই দিনে রাজ্য সিপিএম ঠিক করল, কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দিয়ে শনিবার তাদের মিছিলে প্রতিনিধি পাঠানো হবে!
বিধানসভায় এখন জোট বেঁধেই সরকারের বিরোধিতা করছেন আব্দুল মান্নান, সুজন চক্রবর্তীরা। রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বিতর্কে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে একই সুরে রাজ্য সরকারকে আক্রমণ করছেন কংগ্রেস ও বাম বিধায়কেরা। এই অবস্থায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সাম্প্রতিক বিবৃতিকে অস্ত্র করে বুধবার হঠাৎই বিরোধী জোটকে পাল্টা আক্রমণে চলে গিয়েছে শাসক দল। তৃণমূল বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, কেন্দ্রীয় কমিটি বঙ্গ সিপিএমের রাজনৈতিক কৌশল সংশোধন করতে বলেছে। তা হলে কি সিপিএমের জয়ী বিধায়কেরা ইস্তফা দেবেন এবং ২৬টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে? সরকারি উপ মুখ্য সচেতক তাপস রায় আরও এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, কংগ্রেস-সিপিএমের গোপন প্রেম যখন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, সেই সময়েই কেন্দ্রীয় কমিটির আপত্তিতে বিচ্ছেদ অবধারিত হয়ে উঠেছে!
বিধানসভার ভিতরে যখন শাসক বেঞ্চ থেকে এমন আক্রমণ আসছে, বাইরে তখন জোট রক্ষা করার পক্ষেই ফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলিমুদ্দিন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে কংগ্রেসের মিছিলে বাম পরিষদীয় দলের তরফে প্রতিনিধি পাঠানো হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদেই এ দিন ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছিল কলকাতা জেলা বামফ্রন্ট। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু প্রমুখ মিছিলে থাকলেও কংগ্রেস সেখানে আমন্ত্রিত ছিল না। তবে মিছিলের শেষে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘দলের কাজে কলকাতার বাইরে থাকব ২৫ তারিখ। তবে কংগ্রেসের আমন্ত্রণের প্রেক্ষিতে ওই দিনের মিছিলে বাম পরিষদীয় দল
প্রতিনিধিত্ব করবে।’’
কিন্তু এই প্রশ্নে আবার জটিলতাও বেঁধেছে বামফ্রন্টের অন্দরে। সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের মনোভাবের কথা জেনে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সিপিআই নেতারা এ দিন রাতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেছেন, কংগ্রেসের মিছিলে তাঁদের কোনও বিধায়ক যোগ দিতে যাবেন না। এই অবস্থায় সিপিএম একক ভাবেই বিধায়ক পাঠাবে কি না, তা নিয়ে ফের দলে আলোচনা করতে চান সুজনবাবুরা। ঘটনাচক্রে, এ দিনই দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে ফ ব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার জন্য সিপিএমের কড়া সমালোচনা করেছেন। ইউপিএ-২ জমানায় ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও কেন দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে সঙ্গে নেওয়া হল, সেই প্রশ্ন তুলে দেবব্রতবাবুর মন্তব্য, ‘‘এক ডাকাতকে তাড়াতে আমরা অন্য ডাকাতের হাত ধরতে গেলাম!’’ উদার অর্থনীতির প্রবক্তা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামপন্থা থেকেই বিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
বাম পরিষদীয় দল অবশ্য এ দিনও কংগ্রেসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারই চেষ্টা করেছে। সিপিএমের অশোক ভট্টাচার্য রাজ্যপালের ভাষণ-বিতর্কে অংশ নিয়ে এ রাজ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার সমালোচনা করেন। তার পরেই বলতে উঠে তাপসবাবু সিপিএমকে কড়া আক্রমণের পাশাপাশি তীব্র কটাক্ষ করেন জোটকে। রাহুল গাঁধীর সভা-মঞ্চে গিয়ে কংগ্রেস সহ-সভাপতির সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মালা পরার ঘটনা বা আরও আগে সিপিএমের হাতে কংগ্রেস কর্মীদের খুন হওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন বরানগরের বিধায়ক। বামেদের ‘নির্লজ্জ, বেহায়া’ বলে আক্রমণ করেন তিনি। কংগ্রেস-সিপিএমের জোটকে নিয়ে এমন কিছু মন্তব্যও তিনি করেন, যা অসংসদীয় বলে অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। আক্রমণ চালাতে চালাতে তাপসবাবু যখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নাম না করে দলের প্রতি তাঁর নির্দেশের (বামকরণ চলবে না) প্রসঙ্গও টেনে আনেন, তখন বিরোধী দলের সচেতক মনোজ চক্রবর্তীর নির্দেশে কক্ষত্যাগ করেন কংগ্রেস বিধায়কেরা। একই সঙ্গে বেরিয়ে যান বাম বিধায়কেরাও। এ বারের বিধানসভায় এটাই প্রথম ওয়াক আউট এবং সেটাও যৌথ ভাবে।
কংগ্রেস অবশ্য পরে আবার সভাকক্ষে ফিরে আসে। তাদের দুই বিধায়ক কানহাইয়ালাল অগ্রবাল ও ভূপেন্দ্রনাথ হালদার বিতর্কে অংশ নিয়ে তাপসবাবুর আক্রমণের জবাবও দেন। কিন্তু বামেরা আর সভায় ফেরেনি। এতে কি দু’পক্ষের কক্ষ সমন্বয় ধাক্কা খেল? সংশয় উড়িয়ে বিরোধী দলনেতা মান্নানের জবাব, ‘‘আমরা আমাদের মতো প্রতিবাদ করেছি। বামেরা তাদের মতো করেছে। আমাদের নতুন বিধায়কদের বিধানসভায় বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করব কেন?’’ আর সুজনবাবু, অশোকবাবু, বিশ্বনাথ চৌধুরীরা পরে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাপসবাবুর বেশ কিছু ‘অসংসদীয়’ মন্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান। স্পিকার নথি পড়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন।
যদিও তাপসবাবু নিজের বক্তব্যেই অনড়। আর পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘অসাংবিধানিক শব্দ বা শাসানির যে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা, তার জন্য কক্ষত্যাগ করে বাইরে যাচ্ছেন কেন? অসাংবিধানিক শব্দ বললে তা সংশোধনের বিধি রয়েছে। আসলে ওঁরা এ সব করে সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠার চেষ্টা করছেন!’’