সংসদে উজ্জ্বল উপস্থিতি বা অসাধারাণ বলিয়ে-কইয়ে— এমন একাধিক সাংসদ নেতৃত্বের কোপে পড়েছেন সিপিএমে। —ফাইল চিত্র।
কেউ অভিযোগ করলেই দলীয় রীতি মেনে কমিশন। সিদ্ধান্ত তার পরে যা-ই হোক, কমিশন বসে যাওয়া নেতাদের পার্টি জীবন হয়ে উঠবে দুষ্কর! সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে সিপিএমে।
রাজ্যসভার তরুণ সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওঠা কিছু অভিযোগের তদন্তে তিন সদস্যের কমিশন গড়া হয়েছিল সম্প্রতি। কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে ঋতব্রতকে কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে রাজ্য কমিটি। কমিশন কাজ শুরুর আগেই অবশ্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়ে গিয়েছিল! যা নিয়ে দলের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ। তরুণ ঋতব্রত শুধু একা নন। বর্ষীয়ান প্রাক্তন সাংসদ রূপচাঁদ পালের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য কমিটি। তাঁর বিরুদ্ধে কমিশন বসেছিল বেশ কিছু দিন আগে। হঠাৎ ধুলো ঝেড়ে পুরনো প্রসঙ্গ সামনে এনে সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এই সদস্যকে হলুদ কার্ড দেখানোর প্রস্তুতি চলছে।
হুগলি জেলার রাজনীতিতে এক সময়ে অনিল বসুর গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রবল বিবাদ ছিল রূপচাঁদবাবুর। এখন সে সব অতীত। ঘনিষ্ঠ মহলে বর্ষীয়ান প্রাক্তন অধ্যাপক বলছেন, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংক্রান্ত যে বিষয়ে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে অনায়াসে আদালতে যাওয়া যেত। শিক্ষা দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নালিশ করা যেত। কিন্তু দলীয় কিছু নেতা অভিযোগের বিচার করে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন কী ভাবে? অভিযোগ তো পার্টি সংক্রান্ত বিষয়েই নয়! একই প্রশ্ন দলে ঘুরছে ঋতব্রতকে ঘিরেও। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের অধিকাংশের সঙ্গেই সিপিএমের কোনও যোগ নেই। ব্যক্তিগত জীবন বা আর্থিক বিষয়ের যে বেচালের অভিযোগ উঠছে, তার কিনারা করতে প্রশাসন বা আদালতের দ্বারস্থ হতেই পারতেন অভিযোগকারীরা। অথচ তাঁরা দলের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও দল ওই অভিযোগকারীদের কথায় মান্যতা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কী ভাবে, সিপিএমের ভিতরে-বাইরে এখন চর্চা বিস্তর।
সেরা সাংসদ হয়েছেন। অনেকেই বলেন, তিনি লোকসভার অন্যতম সেরা স্পিকার। এ হেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে তাড়িয়ে দিতেও দ্বিধা হয়নি সিপিএম নেতৃত্বের। —ফাইল চিত্র।
রাজ্য কমিটির আর এক সদস্য মইনুল হাসানের বিরুদ্ধেও একটি কমিশন ঝুলে আছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি রাখার। অথচ মইনুলের পরিবার মুর্শিদাবাদের বনেদি বিত্তবান। তাঁর পরিবারের কেন সম্পত্তি আছে, এই প্রশ্ন তুলে কমিশন বসিয়ে ‘অসম্মানে’র চেয়ে তিনি বরং দল ছে়ড়ে দিতে চান— রাজ্য কমিটিতে সওয়াল করেছিলেন মইনুল। কমিশন এখনও রিপোর্ট দেয়নি। কিন্তু সংখ্যালঘু অংশের উল্লেখযোগ্য, বলিয়ে-কইয়ে নেতা হিসাবে মইনুলের নাম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিবেচনায় এলেই কমিশনের কাঁটা তাঁর পথ আটকে দেবে!
বাম রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য বলছেন, সেই পাঁচের দশকে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিংহ সুরজিতেরা লড়াই চালিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে সংসদীয় গণতন্ত্রে টেনে এনেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তাত্ত্বিক ভাবে দলটা এখনও সংসদীয় ব্যবস্থাকে আপন করতে শেখেনি। দলের ‘পারফরমিং’ সাংসদদের তাই বারবার দলীয় নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়তে হয়। সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, নেপালদেব ভট্টাচার্য, ব্রতীন সেনগুপ্ত, মইনুল হাসান থেকে ঋতব্রত— তালিকাটা দীর্ঘ এবং ক্রমবর্ধমান!
আরও পড়ুন: পৃথক পথের সারথি কারা, প্রশ্ন সিপিএমে
শাহ বানু খোরপোষ মামলায় সংসদে সৈফুদ্দিনের বক্তৃতা প্রায় লোকগাথার পর্যায়ে। অথচ রাজীব গাঁধী কেন তাঁকে ডেকে পরামর্শ করেন, কেন তিনি কংগ্রেসের প্রতি দুর্বল, এই সব প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল কাটোয়ার সাংসদকে। পরে ‘সম্মানজনক বিচ্ছেদ’ চেয়ে নিয়েছিলেন সফি। সোমনাথবাবু ‘সেরা সাংসদে’র পুরস্কার ঘরে এনেছিলেন সিপিএমের হয়ে লড়াই করেই। দলীয় ফরমান মেনে কেন তিনি লোকসভার স্পিকারের পদ ছাড়ছেন না, তাই পত্রপাঠ বহিষ্কার করে দেওয়া হল তাঁকে! রাজ্যসভার সাংসদ নেপালদেব ‘শত্রু শিবিরে’ তথ্য পাচার করছেন, এই অভিযোগে কমিশন বসিয়ে লাল কার্ড দেখানো হয়েছিল তাঁকে। জ্যোতিবাবু তাঁর পিছনে সমর্থনের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে পরে আবার তিনি ফিরেছেন দলে। কিন্তু নেপালেদেবের রাজনৈতিক জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট হয়েছে। রাজ্যসভার তরুণ সাংসদ ব্রতীনও বিপাকে পড়েছিলেন। পরে সিপিএম ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন বিজেপি-তে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পছন্দের পাত্র তিনি, এমনটা বাংলার রাজনৈতিক মহলে সকলেরই জানা। তবে ঋতব্রত যখন কোণঠাসা হচ্ছেন দলে, তখন বুদ্ধবাবু নিরাসক্তই থেকেছেন। —ফাইল চিত্র।
সৈনিকদের পিছনে সেনাপতিদের ভূমিকা চিরকালই গুরুত্বপূর্ণ থাকে। জ্যোতিবাবু এই জন্যই সিপিএমে বরেণ্য নেতা। সৈনিকদের আগলে রাখতে জানতেন বলেই সুভাষ চক্রবর্তী বা নেপালদেবেরা কোণঠাসা হয়েও লড়াই চালাতে পেরেছেন। আজকের মইনুল, ঋতব্রতদের পিছনে দাঁড়ানোর তেমন নেতা কোথায়? ঋতব্রতকে রাজ্যসভার প্রার্থী করতে বিশেষ ভূমিকা ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। কিন্তু পরে বিতর্কের সময়ে তিনি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত থেকেছেন।
আরও পড়ুন: নীতীশের কোপে পদ গেল শরদের
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘ঋতব্রতের কিছু ভুল নিশ্চয়ই আছে। তার জন্য শাস্তি এবং সংশোধনের সুযোগ, সবই প্রাপ্য। কিন্তু যে পদ্ধতিতে বিচার চালানো হল, সেটা হাস্যকর এবং অবমাননাকর!’’
কমিশনের নামে ক্যাঙ্গারু কোর্টের ধারা থেকে বেরোনো হল না সিপিএমের!