দিল্লিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের অবসরে কেরল থেকে দলের নতুন সাংসদ কে রাধাকৃষ্ণনকে সংবর্ধনা ‘দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চে’র। — নিজস্ব চিত্র।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাজকর্মের প্রবল সমালোচনা হয়েছে, প্রতিবাদও হয়েছে। কিন্তু দলের শ্রেণি যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে অন্য দিকে। আর তারই পাশাপাশি বুথ ও গণনা-কেন্দ্রে এজেন্ট রাখায় গুরুতর ঘাটতি থেকে গিয়েছে। রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে দলের ফের বিপর্যয়ের পরে শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা এবং তৃণমূল স্তরে সংগঠনের দুর্বলতা, এই দুই কারণকেই প্রাথমিক ভাবে দায়ী করছে সিপিএম।
লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে কলকাতায় সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। সেই ময়না তদন্তের নির্যাসই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের তরফে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জানানো হয়েছে। দিল্লির হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ ভবনে শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত তিন দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছিল। সূত্রের খবর, দলের বঙ্গ নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পেশ করেছেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য সদস্যেরাও তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছেন। রাজ্য সিপিএমের রিপোর্টেই উঠে এসেছে, এ বার বাংলায় ১০টি জেলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭ হাজার বুথে দলের পোলিং এজেন্ট ছিল না। অর্থাৎ গোটা রাজ্যে প্রায় ১২-১৩% বুথে এজেন্ট ছিল না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রথম দিকে এজেন্ট থাকলেও পরে তাঁরা বেরিয়ে আসায় সেই সব বুথ থেকে সংশ্লিষ্ট ১৭ (সি) ফর্ম দলের কাছে আসেনি। পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ পর্যালোচনার কথা বলছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
প্রচারে এ বার সিপিএম এবং তাদের গণ-ফ্রন্টের উদ্যোগে ভাল সাড়া ছিল। সারা দেশ ও রাজ্যে বিজেপির শক্তি কমানোর ডাক সিপিএম দিয়েছিল, জনতার বড় অংশ তা গ্রহণ করেছেন বলেও দলীয় নেতৃত্বের মত। কিন্তু সেই সঙ্গেই রাজনৈতিক ভাবে তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকেও পরাস্ত করার আহ্বান রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষ গ্রহণ করেননি। বহু ক্ষেত্রে প্রচারে তৃণমূল-বিরোধিতায় যত জোর পড়েছে, বিজেপি-বিরোধিতায় তেমনটা হয়নি। প্রাথমিক ভাবে এই পর্যালোচনার কথাই রাজ্য সিপিএমের তরফে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য রাজ্যের সিপিএমকেই আরও বিশদে বিপর্যয়ের কারণ ও ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজতে বলেছে।
তবে রাজনৈতিক কারণের চেয়েও সিপিএমকে এই মুহূর্তে আরও বেশি ভাবাচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। প্রাথমিক পর্যালোচনাতেই ধরা পড়েছে, বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে নেতৃত্বের কেউ গণনা-কেন্দ্রে যাননি। আবার বহু আগে থেকে আলোচনা, নির্দেশিকা সব থাকা সত্ত্বেও বুথ কমিটি ঠিক মতো তৈরি হয়নি। বুথ সংগঠন না থাকায় ‘ভোটের দিনের পরিস্থিতি কাজে লাগাতে’ দল ব্যর্থ হয়েছে বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। জেলা ধরে ধরে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধানের আগেই রাজ্য সিপিএম তাদের রিপোর্টে পরামর্শ দিয়েছে, ‘নেতৃত্ব-সহ পার্টির সমস্ত সদস্যকে একটা ভাল সময় জনগণের অভ্যন্তরে যেতে হবে। শুধু পার্টি দফতরের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে এলাকায়, জনগণের মধ্যে সময় ব্যয় করতে হবে’।
দল হিসেবে ‘শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা’ রয়েছে শুধু নয়, তা আরও বেড়েছে বলেও মেনে নিচ্ছে সিপিএম। শ্রেণি যোগাযোগের দিকে নজর দিয়েই শ্রমিক, কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের সক্রিয়তা বাড়ানোর ডাক দেওয়া হয়েছে। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, ‘‘প্রাথমিক ভাবে যা পর্যালোচনা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে আমাদের প্রচার মধ্যবিত্ত অংশের মানুষকে ঘিরেই বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরের মতো বামপন্থীদের বরাবরের ভিতের দিকে নজর কম পড়েছে। এই অংশের জন্য আন্দোলন আরও বাড়াতে হবে। আরও গভীরে যেতে হবে।’’
বাংলায় সবিস্তার নির্বাচনী পর্যালোচনা ও পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করার জন্য কল্যাণীতে রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশন হবে অগস্টে। সেই সঙ্গেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে দলের সম্মেলনের প্রাথমিক রূপরেখা ঠিক হয়েছে। শাখা স্তর থেকে সম্মেলন-পর্ব শুরু হয়ে যাবে সেপ্টেম্বরে। রাজ্য সম্মেলন সেরে পার্টি কংগ্রেস বসবে আগামী এপ্রিলে।