রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভায় সিপিএমের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তৃণমূল ভবনে যাচ্ছেন কাকলি ঘোষদস্তিদার। ছবি: শৌভিক দে।
এ যেন অনেকটা রামে-সুগ্রীবে রক্ষে নেই, লক্ষ্মণও দোসর!
দীর্ঘ দিনের জল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলেই যোগ দিলেন রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল ভবনে বুধবার তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন দলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল ভবনে যে কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন মুকুল রায়! কিন্তু যুবরাজের থেকে তৃণমূলের পতাকা নিলেও তাপসবাবুর শাসক দলে যোগদান মসৃণ হয়নি! এমনিতেই রাজারহাট-নিউটাউন এলাকা তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জর্জরিত। তার উপর তাপসবাবুর মতো দাপুটে নেতার অনুপ্রবেশ দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে প্রভাব ফেলবে বলেই ইঙ্গিত মিলছে। সিপিএমের প্রাক্তন পুর-চেয়ারম্যানকে দলে নেওয়ার প্রতিবাদে এ দিনই এলাকায় বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের একাংশ। এলাকায় সিন্ডিকেট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ও বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের অনুগামীদের বিরোধ বারেবারেই প্রকাশ্যে এসেছে। তার মধ্যে তাপসবাবুর অন্তর্ভুক্তি শাসক দলে নতুন ক্ষোভের জ্বালামুখ তৈরি করবে বলে দলেরই একাংশের আশঙ্কা! এমনকী, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বেরও কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তকে ভাল চোখে দেখেননি!
তাপসবাবুর পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরনোর পরে সম্প্রতি ওই পুরসভায় প্রশাসক বসানো হয়েছে। আগামী অক্টোবরে রাজারহাট এবং বিধাননগর পুরসভাকে সংযুক্ত করে নতুন পুর-নিগমের ভোট হওয়ার কথা। তার কয়েক মাসের মধ্যেই বিধানসভার ভোট। এই পরিস্থিতিতে তাপসবাবুকে দলে টানায় অশনি সঙ্কেত দেখছে তৃণমূলের একাংশ। বিধায়ক সব্যসাচী এখন দলের অন্দরে কোণঠাসা। তাঁর শিবিরের ধারণা, তাপসবাবুকে দলে নিয়ে আসা হল বারাসতের সাংসদের হাত শক্ত করে তাঁদের আরও বিপাকে ফেলতে! আগামী বিধানসভা ভোটে তাপসবাবুই সব্যসাচীর কেন্দ্র থেকে টিকিট পেতে পারেন বলেও দলের একাংশের ধারণা। তবে কাকলির দাবি, দলে কোনও গোষ্ঠী রাজনীতি নেই এবং তাপসবাবু দলে এসেছেন তৃণমূল নেত্রীর ‘কর্মযজ্ঞে’ সামিল হতে। কিন্তু সেই একই দিনে খোদ তাপসবাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সাংসদ কাকলির কাজ দেখে উৎসাহিত হওয়ার কথা বলে তৃণমূলের একাংশকে অজান্তেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, শাসক দলে তাঁর পথ খুঁজে পাওয়ার ‘কলম্বাস’ কে!
তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা এবং আশঙ্কার জেরেই এ দিন নারায়ণপুরে রীতিমতো মিছিল করে দাবি উঠেছে, ‘সিপিএমের হার্মাদ, তৃণমূলের উপরে অত্যাচারী তাপস চট্টোপাধ্যায়কে দলে নেওয়া চলবে না’! দলীয় সূত্রের খবর, বিক্ষোভ এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশি নিরাপত্তায় তৃণমূল ভবনে নিয়ে যেতে হয়েছে তাপসবাবুকে। সেখানে আনুষ্ঠানিক যোগদানের সময়ে হাজির ছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কৃষিমন্ত্রী তথা রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসু, তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং পর্যবেক্ষক-বিধায়ক নির্মল ঘোষ।
তাপসবাবুকে নিয়ে দলে ক্ষোভের বিষয়ে পার্থবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমার কাছে বিক্ষোভের খবর নেই!’’ তাঁর দাবি, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনায় তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সংগঠন। সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে অবশিষ্ট কাজটুকু করবেন তাপসবাবু।’’ পূর্ণেন্দুবাবুরও দাবি, ‘‘তাপসবাবুর তৃণমূলে যোগদানে উত্তর ২৪ পরগনায় বামফ্রন্ট বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। এই ধাক্কা ওরা সহজে সামলাতে পারবে না।’’ কিন্তু প্রথম দিনেই ধাক্কা কি তৃণমূলও খায়নি? যদিও পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘দল বড় হলে নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝি কমবেশি হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দলীয় নেতৃত্ব জানেন সবাইকে নিয়ে কেমন করে চলতে হবে। কারণ, আমাদের দলের মধ্যমণি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
এই সে দিন পর্যন্ত রাজারহাটে যাঁর সঙ্গে প্রবল বিরোধ ছিল পূর্ণেন্দু-সব্যসাচীদের, এ দিন সেই তাপসবাবুকেই মধ্যমণি করে বসেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব! তাঁর স্ত্রী গোপা চট্টোপাধ্যায়-সহ স্থানীয় আরও বেশ কিছু নেতাও তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাপসবাবু বলেন, ‘‘আমি সামাজিক মানুষ। সমাজের কাজ করতে চাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে যে কর্মযজ্ঞ করছেন, সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের কাজ দেখে উৎসাহিত হয়ে আমি এই দলে যোগ দিয়েছি।’’ কিন্তু এত দিন বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে থাকার পরে শেষে তৃণমূলে? তাপসবাবুর মন্তব্য, ‘‘বামপন্থা সিপিএমের পৈতৃক সম্পত্তি নয়! মমতার মধ্যে আমি বামপন্থার কয়েকটা দিক দেখেছি।’’
তৃণমূলে যোগদানের পর প্রত্যাশিত ভাবেই পত্রপাঠ তাপসবাবুকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে সিপিএম। দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেছেন, ‘তাপসবাবু পার্টির শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ তো বটেই, পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাও করেছেন।
তাঁর এই কাজে রাজারহাট ও নারায়ণপুর এলাকার মানুষ মর্মাহত’। সিপিএমে থেকেই তাপসবাবু তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রেখে চলতেন বলেও অভিযোগ করেছেন গৌতমবাবু। দলের পলিটব্যুরো সদস্য বিমান বসুও জানান, আগে সিপিএম তাঁর সঙ্গে কথা বলে ঠেকিয়েছিল। তা হলে কি অর্থ বা ক্ষমতার জন্য তাপসবাবু দল ছাড়লেন? বিমানবাবু বলেন, ‘‘তা ঠিক বলতে পারব না। তবে এটা অধঃপতন! উনি ক্লাব-সংগঠন এ সব করে এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। তার পরে দলে আসেন। মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার মাধ্যমে এলে এ ভাবে হয়তো ছেড়ে যেতেন না!’’ সপ্তাহদুয়েক আগে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনের দিন প্রতিবাদ জানিয়ে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তাপসবাবু। সিপিএমের একাংশের ধারণা, তাঁর সঙ্গে রবীন মণ্ডলের বিরোধে দলীয় নেতৃত্ব দ্বিতীয় জনের পক্ষে দাঁড়ানোয় তৃণমূলের পথ বেছে নিলেন ‘রাজারহাটের সুভাষ চক্রবর্তী’!