উত্তর চব্বিশ পরগনা সিপিএমের পার্টি অফিসে গৌতম দেব। বারাসতে সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।
যা ছিল বিভিন্ন স্তরের নিভৃত আলোচনা, তাকেই হঠাৎ প্রকাশ্যে এনে ফেললেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব! আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের সমঝোতার সম্ভাবনা খোলা আছে বলে ইঙ্গিত দিলেন তিনি। তাঁর এই মন্তব্যের জেরেই আলোড়ন উঠল রাজ্য রাজনীতিতে!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে পথে রাজ্যকে নিয়ে চলেছেন, তা থেকে ‘নিস্তার’ পাওয়ার উপায় নিয়ে নানা অঙ্কই এখন কষা হচ্ছে বিরোধী শিবিরে। কোনও সমীকরণই এখনও নির্দিষ্ট চেহারা নেয়নি। কিন্তু বাম ও কংগ্রেস শিবিরের একাংশের মধ্যে জোরালো চর্চা চলছে মমতাকে রুখতে দু’তরফের কাছাকাছি আসা নিয়ে। এমনকী ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তাতে বাম, কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু ছোট দলকে সামিল করা নিয়েও আলোচনা আছে। শাসক দলের মধ্যে থেকেও যাঁরা দলীয় নেতৃত্বের কাজকর্মে ক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধ, তাঁদেরও কেউ কেউ তাকিয়ে আছেন ভবিষ্যতে এমন সমঝোতা গড়ে ওঠার দিকে। সাম্প্রতিক কালে মমতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর নৈকট্য যত প্রকট হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ জোট হিসাবে বাম-কংগ্রেসের কাছাকাছি আসার জল্পনাও তত বাড়ছে। সিপিএমের অন্দরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, গৌতমবাবুরা এই মতেরই সমর্থক বলে একটি সূত্রের খবর। কিন্তু সিপিএমের নীতি মেনেই দলের কেউ এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও ইঙ্গিত দেননি। যা শুক্রবার দিয়ে ফেলেছেন গৌতমবাবু!
বারাসতে দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কিছু কর্মসূচির কথা জানাতে গিয়ে এ দিন প্রশ্নের জবাবে গৌতমবাবু বলেছেন, বিভিন্ন ছোট দলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। বিধানসভা ভোটে যদি বিজেপি-তৃণমূলের জোট হয়, তা হলে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে ভোটের সময় কী হবে, তা নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি বলেও উল্লেখ করেছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক। তিনি বলেছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আটকাতে কংগ্রেসকে তো এক সময় আমরা সমর্থন করেছিলাম। সেই সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।’’ তবে এর সঙ্গেই গৌতমবাবুর সংযোজন, ‘‘কেবল এ রাজ্যের পরিস্থিতি ধরেই তো হবে না, গোটা দেশের পরিস্থিতিতেই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ এক দিকে যেমন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের কথা বলেছেন গৌতমবাবু, তেমন এটাও কবুল করে ফেলেছেন যে, আগামী বিধানসভা ভোটে সিপিএম বা বামেরা একা মমতাকে হারাতে পারবে না। তাই জোটের সম্ভাবনা মাথায় রাখতেই হবে। তৃণমূল ছেড়ে মুকুল রায় কোনও দল গড়লে তাদের হাত ধরার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন গৌতমবাবু।
সিপিএমের অন্দরে প্রত্যাশিত ভাবেই গৌতমবাবুর এমন মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। শারীরিক ভাবে গৌতমবাবু মোটেও পূর্ণ সুস্থ নন। উত্তেজনা বশে রাখা এখন তাঁর পক্ষে কঠিন। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে তাঁর মন্তব্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ সিপিএমের একাংশ। আবার দলের অন্য অংশ এবং বিভিন্ন বাম শরিক দলের নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, এই বিষয়ে বামফ্রন্টে সহমত ছাড়াই কেন মন্তব্য করতে গেলেন গৌতমবাবু? বিশাখাপত্তনমে গত এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেসেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, অ-কংগ্রেস এবং অ-বিজেপি দলগুলিকে নিয়ে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করার চেষ্টা হবে। কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার কথা সেখানে নির্দিষ্ট ভাবে নাকচ করা হয়েছে। তার পরেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু কেন এমন কথা প্রকাশ্যে বললেন, প্রশ্ন উঠেছে বাম শিবিরেই। যদিও প্রশ্নের জবাবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেছেন, ‘‘যত দূর জেনেছি, নির্বাচনী সমঝোতার প্রসঙ্গে গৌতম দেব নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলেননি। তা-ই নিয়ে মন্তব্য করারও কিছু নেই। আমরা আমাদের আশু আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েই এখন ভাবছি।’’ বস্তুত গৌতমবাবুও এ দিন জেলার কৃষক সভাকে নিয়ে ১০ অগস্ট নবান্ন অভিযান, জুলাইয়ে থানা ঘেরাও, দু’শো মহিলার দল গড়ে নারী নির্যাতনের অভিযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জোট-মন্তব্যের জন্য সে সবই পিছনে চলে গিয়েছে!
ঘটনা হল সিপিএম ও কংগ্রেসের একাংশ মনে করে— রাজ্যের স্বার্থে ২০১৬-য় যে ভাবে হোক মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা দরকার। কিন্তু কোনও বিরোধী দলেরই এখন একক ভাবে সেই ক্ষমতা নেই। সমঝোতাপন্থীদের হিসাব বলছে, নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেও বামেরা গত লোকসভা ভোটে প্রায় ৩০% ভোট পেয়েছে। শাসক দলের নানা ‘সন্ত্রাস’ মোকাবিলা করেও তারা গত পুরভোটে ২৫%-এর বেশি ভোট ধরে রেখেছে। এর সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট যোগ করতে পারলে আগামী বিধানসভায় ৪০%-এর কোঠায় ভোট পেয়ে তৃণমূলকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া সম্ভব। এই অঙ্ক থেকেই বিধানসভা ভোটে প্রয়োজনে বামেদের সঙ্গে আসন সমঝোতার পক্ষপাতী আব্দুল মান্নান, সোমেন মিত্র, প্রদীপ ভট্টাচার্যেরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও এমন সমীকরণের খুব বিরোধী নন বলে দলের একটি সূত্রের খবর। গৌতমবাবুর মন্তব্যের পরে অধীরের বক্তব্য এ দিন জানা যায়নি। তবে মান্নান বলেছেন, ‘‘হিটলারকে রুখতে আমেরিকা আর রাশিয়া যদি এক জায়গায় আসতে পারে, মোদীর দলকে রুখতে যদি বিহারে লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার একজোট হতে পারেন, তা হলে এটাই বা অসম্ভব কেন?’’
আবার বাম-কংগ্রেস সমঝোতার পথে কাঁটাও কম নেই। একে তো বামফ্রন্টে এই নিয়ে ঐকমত্য নেই। তা ছাড়া, গত লোকসভা ভোটে সিপিএম এ রাজ্যে দু’টি আসন জিতেছে কংগ্রেসের ঘাঁটিতে তাদের হারিয়েই! মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের মতো জেলায় কংগ্রেসের সংগঠন যেখানে শক্তিশালী, সেখানে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বামেরাই। কাজেই এমন দু’দলের সমঝোতা বাস্তবে সম্ভব কি না, তা নিয়ে দুই শিবিরেই সংশয় আছে। তবু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার জন্য সব রাস্তাই খতিয়ে দেখা চলছে। তার মধ্যেই গৌতমবাবুর মন্তব্য জল্পনায় ইন্ধন দিল। আবার কারও কারও মতে, গৌতমবাবু এত আগে প্রকাশ্যে মুখ খুলে ফেলাতেই বাম-কংগ্রেস সমঝোতার যাবতীয় সম্ভাবনায় জল ঢালা হয়ে গেল!