বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সত্যিই কি তা-ই? বাংলায় বাম-কংগ্রেস জোটের ‘মুখ’ কি তিনিই?
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য পাল্টা প্রশ্ন করছেন, ‘‘আমায় জিজ্ঞাসা করছেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর তো আমার দেওয়ার কথা নয়। দল যা ঠিক করবে তা-ই হবে।’’ কিন্তু বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের আলোচনায় তাঁর নাম আসছে। তিনি নিজেও আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘রাজনৈতিক’। আগে তাঁর পরিচয় ছিল ‘আইনজীবী-রাজনীতিক’। এখন ‘রাজনীতিক-আইনজীবী’। বাংলা থেকে একমাত্র বামপন্থী সাংসদ। বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা তাঁর। আদালতে এবং আদালতের বাইরে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য সব সময়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি নিজেও কি নিজেকে তৃণমূলের বিরোধী জোটের ‘মুখ’ বলে দেখতে বা ভাবতে শুরু করেছেন? বিকাশ বলছেন, ‘‘এটা আমার বিষয় নয়। মানুষের বিষয়।’’ অস্যার্থ— তিনি ‘না’ বলছেন না। বলছেন না যে, তিনি শুধুমাত্র আদালতের চৌহদ্দির মধ্যেই সন্তুষ্ট। আর ‘না’ বলবেনই বা কেন? শহুরে, বাঙালি ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। বিনা পয়সায় মামলা লড়েন। এর সঙ্গে যোগ করুন কলকাতার মেয়রের পদে থাকার পাঁচ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা (এক বার পুর অধিবেশন চলাকালীন তাঁর ঝিমোনোর ছবি প্রকাশ্যে আসায় বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। তাঁর হিতৈষীরা অবশ্য বলেছিলেন, ঘুম নয়, বিকাশ চোখ বুজে খানিক এনার্জি সংগ্রহ করছিলেন)। মনে রাখতে হবে, কলকাতা পুরসভা এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের নিজস্ব বাজেট পেশ করতে হয়। ফলে ‘মুখ’ হতে বা ভাবতে অসুবিধা কোথায়?
অনেকে অবশ্য বলছেন, ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের এখনও অনেক দেরি। সেই ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট যে হবেই, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে এখন থেকে ‘মুখ’ নিয়ে কেন ভাবনাচিন্তা করা হবে! এখন বরং পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন এবং তার প্রস্তুতি নিয়ে চিন্তা করার সময়।
ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, পঞ্চায়েত ভোট থেকেই ভবিষ্যতের ভোটের সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিতে চাইছেন দুই শিবিরের কুশীলবেরা। দ্বিতীয়ত, বিকাশও পঞ্চায়েত ভোটের এই সময়ে ‘আক্রমণাত্মক’ ভূমিকায় দেখা দিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যেই দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে জানিয়েছেন, মার খেলে পাল্টা মার দিয়ে আসতে। আইন-আদালতের দিকটা তিনি ‘বুঝে নেবেন’। এই বিবৃতি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন অনেকে। বস্তুত, বিকাশের এই বিবৃতি নিয়ে আইনজীবী এবং রাজনৈতিক মহলে আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছেন। কংগ্রেসের এক আইনজীবী নেতা যেমন সোমবারই বলছিলেন, ‘‘বিকাশদা মারাত্মক কথা বলে দিয়েছেন!’’
৭১ বছরের বিকাশের ‘রাজনীতিক’ বা ‘আইনজীবী’ পরিচয় নতুন নয়। কলেজ থেকেই তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত। সত্তরের দশকে কারাবাসও করেছেন। তাঁর ‘মুখ’ সামনে রেখেই ২০০৫ সালে কলকাতা পুরসভা তৃণমূলের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেছিল সিপিএম। গত লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুরে প্রার্থীও হয়েছিলেন। তবে প্রবল মোদী হাওয়ায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু ভোটে হেরে রাজনীতি থেকে চলে যাননি। বলেছিলেন বটে, ‘‘আমার হারানোর কিছু নেই। নিজের পেশায় ফিরে যাব। আইনজীবী হয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করব।’’ পেশায় ফিরেছেন। কিন্তু আরও বেশি ‘রাজনীতিক’ হয়েছেন। আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন আদালতে সারদা, নারদ মামলা লড়েছেন। ঘনিষ্ঠেরা বলেন, অনেক সময়েই স্বোপার্জিত অর্থে বিমানের টিকিট কেটে সুপ্রিম কোর্টে ওই মামলায় সওয়াল করতে গিয়েছেন বিকাশ। পারিশ্রমিক বকেয়া থেকেছে। বিকাশ কিছু বলেননি। কারণ, তিনি ‘নীতি এবং আদর্শের লড়াই’ লড়তে চেয়েছেন। হয়েছেন ত্রিপুরার অ্যাডভোকেট জেনারেলও। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করেননি।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা হওয়ার অবকাশ থাকত না। ওই মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশাপাশিই বিকাশের নাম চলে আসে। বহু বিচারপ্রার্থীই সুরাহা পেতে আইনজীবী হিসেবে বিকাশকে চান। খোঁজ নেন, তাঁর পারিশ্রমিক কত। যদিও বিকাশ অনেক মামলায় বিনা পারিশ্রমিকেও সওয়াল করেন। এখন রাজ্য রাজনীতির অনেকটাই আদালত-নির্ভর। তাই বিকাশের গুরুত্ব বাড়ছে। আর তিনি বলেছেন, ‘‘আমার সামগ্রিক লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে।’’ সেই কারণেই চাকরিপ্রার্থীদের একটা অংশের হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়ছেন তিনি।
২০২০ সালে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়ে রাজ্যসভা নির্বাচনে জিতেছেন। সেই বছরের ২২ জুলাই থেকে তিনি সাংসদ। মেয়াদ ফুরোনোর কথা ২০২৬ সালের জুলাইয়ে। ঘটনাচক্রে, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের বছরেই। অর্থাৎ, এপ্রিল-মে মাসে ভোটের সময়েও বিকাশ ‘বাম-কংগ্রেস জোট’-এর সাংসদই থাকবেন।
তবে এখন বাম-কংগ্রেস জোটের যে চেহারা, তাতে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যায় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিচু স্তরে কেমন লড়াই হয়, কত জায়গায় দুই জোটসঙ্গীর মধ্যে লড়াই হয়, তা-ও দেখার। তবে অনেকেই বলেন, একেবারে স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে অনেক সময়েই আশ্চর্য সমঝোতা হয়ে যায় স্থানীয় বিষয়ের ভিত্তিতে। তার প্রভাব বিধানসভা বা লোকসভার মতো সাধারণ নির্বাচনে পড়ে না।
‘মুখ’ হওয়ার দৌড়ে বিকাশের পাশাপাশি যাঁরা থাকতে পারেন, তাঁদের একজন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। দ্বিতীয় জন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। প্রথম জন সংখ্যালঘু। রাজ্যে মন্ত্রিত্ব করেছেন। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় ছিলেন। ফলে ‘রাজনীতিক’ হিসেবে বিকাশের চেয়ে তিনি অনেকটাই এগিয়ে। আবার বয়সেও তরুণতর। সেলিম এখন ছেষট্টি। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এখন রাজ্যে সংগঠনের দায়িত্বে। সিপিএমের মতো ‘ক্যাডারভিত্তিক’ দলে কি সংগঠনের শীর্ষপদ থেকে এসে মুখ্যমন্ত্রী ‘মুখ’ হওয়া সম্ভব? অনেকেই নিশ্চিত নন। অধীর আবার বরাবর রাজ্যের চেয়ে দিল্লির রাজনীতি নিয়ে বেশি আগ্রহী। বহরমপুর থেকে টানা পাঁচ বারের সাংসদ তিনি। সেখানে মাত্র এক বার নবগ্রাম বিধানসভা থেকে জিতে রাজ্যের বিধায়ক হয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি ‘বাইরনকাণ্ডে’ অধীরের মুখ পুড়েছে।
বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে বরাবরই সরব প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। বিকাশের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নিয়ে অবহিত রাজ্য রাজনীতির সকলেই। ২০১৭ সাল থেকে ‘জোটের প্রার্থী’ হিসাবে বিকাশকে রাজ্যসভায় পাঠানোর প্রবক্তা ছিলেন মান্নান। তিনি অবশ্য এত আগে থেকে বিধানসভার ‘মুখ’ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে প্রবীণ নেতার ঘনিষ্ঠমহল সূত্রের দাবি, জোট নিয়ে মান্নান এখন বিরক্ত। তিনি অতীতে বালিগঞ্জ, কালিয়াগঞ্জে জোট চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। আবার সাগরদিঘির উপনির্বাচনে জোট হয়ে ‘অধীরের প্রার্থী’ বাইরন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে জেতার পরেও তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এ সব পরিস্থিতির কারণেই এখন জোট নিয়ে মান্নান মুখ খুলতে নারাজ বলে জানাচ্ছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। তাঁদের বক্তব্য, পঞ্চায়েত এবং লোকসভা নির্বাচনের পরে রাজনীতি কোন মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে এত আগে মন্তব্যে নারাজ পোড়খাওয়া রাজনীতিক।
প্রসঙ্গত, গত লোকসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে জোট না হলেও যাদবপুরে বিকাশের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। তবে ২০২১ সালের জুন মাসে সমাজমাধ্যমে বিকাশের একটি পোস্টে ‘কংগ্রেসি গুন্ডা’ শব্দবন্ধ থাকায় বেজায় চটেছিল প্রদেশ কংগ্রেস। তারা আলিমুদ্দিনকে চিঠিও পাঠায়। অভিযোগ জানানো হয়েছিল সনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীকেও। তবে সে জল খুব বেশি দূর গড়ায়নি।