বন্ধ সমর্থনকারীকে রেললাইন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। ছবি: নির্মল বসু।
সিপিএমের পার্টি অফিস ভাঙচুর, বন্ধ সমর্থকদের ধরে পানা-পুকুরে চোবানো, পুলিশকে মারধর, হাতাহাতি, মারামারি— সাধারণ ধর্মঘটে দফায় দফায় এমন নানা ঘটনার সাক্ষী থাকল বসিরহাট।
বুধবার সকাল ৭টা নাগাদ ভ্যাবলা স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় বন্ধ সমর্থকেরা লাইনের উপরে বসে পড়ে ট্রেন অবরোধ করেন। প্রতিবাদ করতে জুটে যায় তৃণমূলের লোকজন। গুটি কয়েক বন্ধ সমর্থককে তখনকার মতো হঠিয়ে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি পুলিশকে। অবরোধকারীরা সরে যাওয়ায় হাসনাবাদ-বারাসাতের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু তখনও অনেক ওঠাপড়া বাকি।
বেলা ৮টা নাগাদ বারাসতের দিক থেকে হাসনাবাদের দিকে যাওয়া ট্রেনটি ভ্যাবলা স্টেশনে এলে লাল পতাকা হাতে লাইনের উপরে বসে পড়েন বামপন্থীরা। রে রে করে তেড়ে যায় তৃণমূলের পতাকাধারীরা। শুরু হয় দু’পক্ষের টানাহেঁচড়া। জনতার তুলনায় অনেক কম পুলিশকর্মী থাকায় প্রথম দিকে তাদের কেবল দর্শকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। সেই সুযোগে দু’পক্ষের মারপিট বেধে যায়। ট্রেন আটকাতে লাইনের উপর শুয়ে পড়েন সিপিএমের বসিরহাট ২ লোকাল কমিটির সম্পাদক সোনালি দাস। তাঁর দাবি, মহিলা পুলিশ না আসা ইস্তক লাইন ছেড়ে উঠবেন না।
এ দিকে, মহিলাকর্মী সঙ্গে না থাকায় ‘অসহায়’ পুলিশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তৃণমূল। তারা নিজেদের দলেরই দুই মহিলা কর্মীকে জোগাড় করে আনে। সিপিএম নেত্রীকে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। ইতিমধ্যে তৃণমূল ও বামেদের মধ্যে হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে। সে সময়ে সিপিএমের দুই যুব নেতা রাজু দাস এবং দীপঙ্কর শিকদার লাইনের উপরে শুয়ে পড়েন। এ বার পুলিশ না ডেকে দায়িত্ব নেয় তৃণমূলই। দীপঙ্করবাবুদের চ্যাংদোলা করে তুলে এনে ট্রেনলাইনের পাশে কচুরিপানা-ভরা ডোবায় ছুড়ে ফেলা হয়।
তাতেও মনোবলে চিড় ধরেনি বন্ধ সমর্থকদের। বিক্ষোভকারীদের আরও কয়েক জন লাইনের উপরে শুয়ে পড়েন। বন্ধ বিরোধীদের সাহায্য নিয়ে পুলিশ তাদের চ্যাংদোলা করে তুলে আনে। ততক্ষণে যুযুধান দু’পক্ষ রেললাইনের ধার থেকে পাথর তুলে ছোড়াছুড়ি শুরু করেছে।
রেললাইন ছেড়ে চৌমাথা-ন্যাজাটের মধ্যে ভ্যাবলা রেলগেটের কাছে রাস্তার উপরেও গোলমাল ছড়িয়ে পড়ে। তৃণমূলের লোকজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে দেখে প্রতিবাদ করে সিপিএম। আর একপ্রস্থ মারপিট বাধে। এই ঘটনায় আহত হয়ে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি হন সিপিএমের যুব সংগঠনের বসিরহাট ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক বিশ্বজিৎ বসু।
খবর পেয়ে বসিরহাট থানার আইসি বিশাল বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে দু’পক্ষকে দু’দিকে সরিয়ে দেন। র্যাফ নিয়ে আসেন বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিপিএম এ বার মিছিল করে চৌমাথায় রাস্তার উপরে বসে পড়লে পুলিশ লাঠি চালায় বলে অভিযোগ। ওই এলাকা থেকে পুলিশ ৬ জনকে গ্রেফতার করে। তাতে উত্তেজনা আরও বাড়ে। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ থানা, ত্রিমোহনী, রেজিস্ট্রি অফিস, বোটঘাট থেকে বন্ধ সমর্থকেরা জড়ো হয়ে ফের ভ্যাবলা স্টেশনে যায়। সে সময়ে সেখানে তৃণমূলের লোকজন কম ছিল। নানা ভাবে আস্ফালন করতে দেখা যায় বন্ধ সমর্থকদের।
তা দেখে তৃণমূল নেতা পরিমল মজুমদার ফোন করে লোকজন ডেকে নেন। এ বার পিছু হঠে বামপন্থীরা। সে সময়ে একজন এসে বলে, তাঁর অটো রিকশার কাচ ভেঙেছে বন্ধ সমর্থকেরা। আর যাবে কোথায়! তৃণমূলের লোকজন পুলিশের সামনেই তাড়া করে ধরে ফেলে কয়েক জন বন্ধ সমর্থককে। শুরু হয় মারধর। সিপিএমের ভুট্টো গাজিকে ভাল রকম পেটানো হয়েছে বলে অভিযোগ। এ বারেও বাহিনী নিয়ে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বসিরহাট থানার আইসি গৌতম মিত্র। তিনি তৃণমূলের লোকজনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
তৃণমূল নেতা তথা বসিরহাট পুরসভার পরিষদীয় দলনেতা পরিমল মজুমদার বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চান না, মানুষের অসুবিধা করে বন্ধ ডাকা হোক। তাই সাধারণ মানুষের যাতে কর্মস্থলে যেতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে জন্য আমাদের রাস্তায় নামা। বামপন্থীরা আমাদের উপরে হামলা চালাচ্ছে দেখে মানুষ তার প্রতিবাদ করেছেন।’’ অন্য দিকে, সিপিএমের বসিরহাট ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতাপ নাথ বলেন, ‘‘পুলিশকে সামনে রেখে তৃণমূলের লোকজন মস্তানি করে আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের মারধর করেছে। পুকুরে ফেলে দিয়েছে।’’
হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলি এবং যোগেশগঞ্জে বন্ধের পক্ষে যেমন মিছিল বের হয়, তেমনি বন্ধের বিপক্ষেও মিছিল বেরিয়েছিল। যোগেশগঞ্জ বাজারে দু’পক্ষের মারামারির সময়ে এক এএসআই সর্বাশিস কুণ্ডু এবং দুই সিভিক ভলান্টিয়ার সিদ্ধার্থ মৃধা, মেঘনাথ বরকন্দাজ-সহ জনা দ’শেক আহত হন। যোগেশগঞ্জে সিপিএমের পাটি অফিস ভাঙচুর করা হয় বলেও অভিযোগ। যদিও হেমনগর উপকূলবর্তী থানার ওসি অমলেশ বালা বলেন, ‘‘তৃণমূলের মিছিলের পাশাপাশি সিপিএমের দুই গোষ্ঠী লাঠি নিয়ে মিছিল করে। যোগেশগঞ্জ বাজারে সিপিএমের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি বাধলে তা ঠেকাতে গিয়ে লাঠি এবং ইটের ঘায়ে আমাদের তিন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন।’’
এ কথা মিথ্যা বলে দাবি করে সিপিএমের হিঙ্গলগঞ্জ ২ লোকাল কমিটির সম্পাদর রবি বিশ্বাস বলেন, ‘‘তৃণমূলের বাইকবাহিনী আমাকে আক্রমণ করলে পুকুরের জলে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচাই। আমাকে না পেয়ে ওরা পার্টি অফিস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।’’ তৃণমূল নেতা দেবেশ মণ্ডলের অবশ্য দাবি, ‘‘ওদের নিজেদের দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে পার্টি অফিস ভাঙচুর হয়েছে। ওদের ছোড়া ইটের আঘাতে তিন পুলিশকর্মীর মাথা ফেটেছে। এখন আমাদের নামে দোষ চাপিয়ে নাটক করছে।’’
বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক, নির্মল বসু, সামসুল হুদা ও শান্তনু হালদার।