শিল্পের দাবিতে বামেদের কৃষক মিছিল। ফাইল চিত্র।
মুম্বই, দিল্লিতে হচ্ছিল। এ বার কলকাতার বুকেও লাল পতাকা নিয়ে হেঁটে এলেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। রাজ্যের সাম্প্রতিক সব নির্বাচনে যাদের ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ থামছে না, ক্ষমতায় যারা নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতায় ফেরার আশাও নেই, সেই সিপিএমের ডাকে এমন পদযাত্রা এবং সমাবেশ নতুন করে চর্চার জন্ম দিয়েছে লোকসভা ভোটের আগে।
কৃষকদের সমস্যার প্রতিকার ও শিল্পের দাবিতে সিঙ্গুর থেকে রাজভবন পর্যন্ত পদযাত্রার উদ্যোক্তা ছিল সিপিএমের কৃষক সভা ও ক্ষেতমজুর সংগঠন। মিছিলে পাকা মাথার পাশাপাশিই চোখে পড়েছে স্লোগানরত তরুণ প্রজন্মের সারি। যাদের ছবি দ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এই পদযাত্রার ‘সাফল্যে’ ভর করে এ বার ৩ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশে ময়দান উপচে ফেলার স্বপ্ন দেখছে আলিমুদ্দিন। তারও আগে ৬ ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ডাক দিয়ে মহানগরে মহাজাতি সদন থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত আরও এক বার মহামিছিল করে দেখানোর প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে বাম শিবিরে। কিছু দিন আগে ডানকুনিতে ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সমাবেশেও জমায়েত হয়েছিল ভাল। কিন্তু মাঠে-ময়দানের ভিড় যাদের ভোটে রূপান্তরিত হচ্ছে না, তারা লোক আনতে পারছে কী ভাবে, রাজনৈতিক শিবিরে চর্চার বিষয় সেটাই।
সিপিএম নেতৃত্বের মতে, কেন্দ্রের বিজেপি এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রতি তৃণমূল স্তরে মোহভঙ্গ হচ্ছে বলেই সাংগঠনিক চেষ্টা কিছুটা হলেও ফল দিচ্ছে। যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোযের দাবি, ‘‘তৃণমূল অক্সিজেন দিচ্ছে বলেই মরে যাওয়া সিপিএমও কর্মসূচি করছে!’’ যে দাবিকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, সিপিএম রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে নানা কুকীর্তির পরে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন কর্মসূচির বিরোধিতা মানুষ মানছেন না বলেই তাদের ভোট আসছে না।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের যুক্তি, ‘‘একটা দল মন্দির-রথ নিয়ে ব্যস্ত, অন্য একটা দল কার্নিভাল-ফেস্টিভ্যালে! মানুষের রুটি-রুজি, রোজকার জীবনের লড়াইয়ের কথা আমরা বলছি।’’ সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, ক্ষমতা হারানোর পরে আর্থিক স্বচ্ছলতা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে দলের সর্বক্ষণের কর্মী কমে গিয়েছে। এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের জীবিকা সামলে তবেই দলের কাজ করেন। শাসক পক্ষের ‘আগ্রাসনে’র মোকাবিলা করে এঁদের কর্মসূচিতে টেনে আনতে সময় লাগছে। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকার নানা দাবি করলেও কাজের সুযোগ যে তৈরি হচ্ছে না, তার ফলে ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের মোহভঙ্গ হচ্ছে। আবার উল্টো দিকে, বিজেপিকে নিয়ে নানা হইচই হলেও ‘বাস্তবোচিত’ দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে তাদের দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, এমনকি উত্তরপ্রদেশ, বিহারেও বামেরা কর্মসূচিতে ভিড় করে দেখাতে পারলে বাংলায় কেন পারছে না— এই প্রশ্নটা সংগঠনকে কোথাও ঝাঁকুনি দিয়েছে!
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো কিছু জেলায় সিপিএমের বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশ কিছু কার্যালয় সাম্প্রতিক কালের মধ্যে আবার খুলেছে। নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের বাসিন্দা বিপ্লব মান্না এ বার পদযাত্রায় এসেছিলেন, রাত কাটিয়েছেন বালি জুটমিলের কোয়ার্টারে। তাঁর বক্তব্য, তাঁদের এলাকা থেকে বামেরা প্রায় মুছে যাওয়ার পরে ‘লুটে খাওয়া’র যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পাচ্ছেন। সিঙ্গুরের আরতি সর্দার, পুরুলিয়ার পরীক্ষিৎ মাহাতো, ভাঙড়ের আবুল হোসেন বা জগৎবল্লভপুরের মঞ্জরী পণ্ডিত— সকলেরই মুখে এলাকার জ্বলন্ত সমস্যার কথা।
সিপিএমের অন্দরেই অবশ্য প্রশ্ন, তৃণমূল জমানাতেই নবান্ন অভিযানে অস্তিত্ব জানান দিয়ে সংগঠন আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল! রাস্তার ভিড় কি আদৌ ভোটবাক্স পর্যন্ত যাবে?