নিহতের বাড়িতে তালড্যাংরার প্রাক্তন বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্র। (ইনসেটে) অরুণ সর্দার। ছবি: শুভ্র মিত্র।
যিনি নিজে সর্বক্ষণ গ্রামের লোকেদের একা বেরোতে নিষেধ করতেন বিপদের আশঙ্কায়, সেই তিনিই কিনা একা চলে গেলেন মেলা দেখতে! আর সেই যাওয়াটাই কাল হল, আক্ষেপ নিয়োগীডাঙার নিহত সিপিএম কর্মী অরুণ সর্দারের পরিবারের।
বুধবার নিজের দর্জির দোকান বন্ধ করে একাই গোয়ালতোড়ের খয়েরবনিতে মেলা দেখতে গিয়েছিলেন নিয়োগীডাঙার সিপিএম কর্মী অরুণ। বৃহস্পতিবার সকালে সেখানেই তাঁর রক্তাক্ত দেহ মিলেছে। এলাকাটি তালড্যাংরা ব্লক ও থানার আওতায় পড়লেও বিধানসভা হিসাবে বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের মধ্যে। ঘটনা হল, এ বার বিধানসভা ভোটে বিষ্ণুপুরের তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরাজিত হয়েছেন জোটের কংগ্রেস প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের কাছে। ভোটের প্রচার লগ্ন থেকেই আমড্যাংরা, সাতমৌলি এবং শালতোড়া— এই তিন পঞ্চায়েত এলাকায় সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ বারবার উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
নিয়োগীডাঙা আমড্যাংরা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। ঘটনা হল, আমড্যাংরা, সাতমৌলি এবং শালতোড়ায় তৃণমূল এ বার বেশি ভোট পেয়েছে কংগ্রেস প্রার্থীর চেয়ে। সাতমৌলি অঞ্চলে প্রায় ১১০০, আমড্যাংরায় প্রায় ৬০০ এবং শালতোড়া অঞ্চলে প্রায় ২০০ ভোটে তৃণমূল প্রার্থী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এগিয়েছিলেন। তার পরেও বারবার এই এলাকায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ঘটনা কেন ঘটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এলাকাবাসীদের একাংশ জানাচ্ছেন, গত লোকসভা ভোটে এই তিনটি এলাকা থেকে তৃণমূল প্রায় ৯ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল। এ বারও অন্তত ৮ হাজার ভোটে ‘লিড’ নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল শাসকদল। অভিযোগ, বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসানি দিয়ে ভোট দিতে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। জোট প্রার্থীর এজেন্ট হওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তৃণমূল।
এই তিনটি অঞ্চলের ৪০টি বুথের মধ্যে ১২টিতে এজেন্টই দিতে পারেনি জোট। এত কিছুর পরেও সে রকম ‘লিড’ মেলেনি। লোকসভার তুলনায় বরং ভোট অনেকটাই কমেছে। শ্যামবাবুর মতো দাপুটে তৃণমূল নেতাও ৮৯১ ভোটে হেরে গিয়েছেন জোট প্রার্থীর কাছে। বিষ্ণুপুরের বহু তৃণমূল কর্মীরই দাবি, ওই তিন অঞ্চলে আর কিছুটা লিড বাড়লে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীকে এত কম ব্যবধানে হারতে হতো না।
সিপিএমের অভিযোগ, সেই আক্রোশেই ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে ‘বদলার রাজনীতি’ শুরু হয়েছে। জোট কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছে তৃণমূল। রাস্তাঘাটে বের হলে মারধর করা হচ্ছে। জোট কর্মীদের বাড়িতে ঢুকে হামলা করা হচ্ছে। এলাকায় বোমাবাজি করে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগেই তুষারকান্তিবাবু এবং সিপিএম নেতা মনোরঞ্জন পাত্রকে শালতোড়া এলাকার একটি চা দোকানে পেয়ে হামলা চালায় তৃণমূল কর্মীরা। তাঁদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আমড্যাংরা পুলিশ ফাঁড়িতে তাঁরা অভিযোগ জানাতে গেলে সেখানেও তৃণমূলের লোকজন তাঁদের ঘেরাও করে রাখে বলে অভিযোগ। মনোরঞ্জনবাবুর বাড়িতেও হামলা হয়েছে।
অরুণের গ্রামের ছবিটাও আলাদা নয়। নিয়োগীডাঙা মূলত সিপিএম সমর্থক গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানায় থাকা এই গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, ভোটের আগে তৃণমূলের কর্মীরা গ্রামে এলে হুমকি দিয়ে যেত, এলাকার একটিও পরিবারের লোককে যাতে বুথের আশেপাশেও দেখা না যায়! অথচ হুমকি ও ভয় উপেক্ষা করেই গ্রামবাসীরা এ বার বুথমুখো হয়েছিলেন। গ্রামবাসীদের বুথে নিয়ে যেতে অরুণ বড় ভূমিকাও নিয়েছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে।
অরুণের বাড়িতে গিয়ে এ দিন দেখা গেল, গোটা গ্রামের লোক ভিড় করেছে করেছে সেখানে। তাঁর বৃদ্ধা মা মালতিদেবী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “ভোটের পর থেকেই ছেলেটাকে আমার মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। সত্যি সত্যিই মেরে ফেলল!’’ অরুণের স্ত্রী আর্চনাদেবী তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে গোয়ালতোড় থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে থাকা, অরুণের বাবা কানন সর্দার অভিযোগ করেন, ‘‘বিধানসভা ভোটের সময় ছেলে সিপিএমের মিটিং-মিছিলে গিয়েছিল। নির্বাচনের ফল বেরনোর পর থেকেই স্থানীয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ছেলেকে খুন করার হুমকি দিচ্ছিল। তৃণমূলের লোকেরাই এই ঘটনায় জড়িত।”
গ্রামবাসীদের বড় অংশ জানাচ্ছেন, ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই গ্রামে পঞ্চায়েতের নলকূপে জল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন তৃণমূলের বাইক-বাহিনী এলাকায় চক্কর মারতে এসে হুমকি দেয়। বোমা ফাটায় সিপিএম কর্মীদের বাড়ির সামনে। নিহতের ভাই সুকুমার সর্দারের অভিযোগ, “বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তৃণমূলের লোকজন দাদাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগে গ্রামে বোমাবাজিও করেছিল ওরা।’’
পরিস্থিতি এমনই যে এলাকার লোকজন ইদানীং একা একা বাড়ির বাইরে কোথাও বের হচ্ছেন না। যেখানেই যাচ্ছেন জোট বেঁধে যাচ্ছেন। সুকুমার জানাচ্ছেন, তাঁর দাদা নিজে গ্রামবাসীদের বারবার সতর্ক করতেন, এই পরিস্থিতিতে একা যেন কেউ কোথাও না বেরোন। “সবাইকে সাবধান করেও দাদা নিজেই ভুলটা করে বসল। বুধবার রাতে একাই চলে গেল মেলায়। সেই যাওয়াটাই কাল হল!”— আক্ষেপ ঝরে পড়ে সুকুমারের গলায়।
খুনের ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও শ্যামবাবু ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। এলাকার এক তৃণমূল নেতার অবশ্য বক্তব্য, “এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। সিপিএম ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছে।’’ জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ঘটনার কথা জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’