গেরুয়া ছোঁয়া বিধানসভাতেও

টানা আট বারের জেতা কেন্দ্রেই জামানত বাজেয়াপ্ত সিপিএমের

তিনি ছিলেন সিপিএমের আট বারের জয়ী প্রার্থী। তাঁর মৃত্যুতেই বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের উপনির্বাচন। কিন্তু সেই নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু যে দলের কাছে এত বড় ক্ষত হয়ে দাঁড়াবে, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি বামেরাও। উপনির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সিপিএম প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তীর! প্রয়াত প্রাক্তন শিক্ষক নারায়ণবাবুর সঙ্গে এলাকার পরিচিতি ছিল অতি নিবিড়। বিরোধীদের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন সজ্জন মানুষটি।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৫
Share:

রঙের জোয়ারে ভাসলেন বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

তিনি ছিলেন সিপিএমের আট বারের জয়ী প্রার্থী। তাঁর মৃত্যুতেই বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের উপনির্বাচন। কিন্তু সেই নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু যে দলের কাছে এত বড় ক্ষত হয়ে দাঁড়াবে, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি বামেরাও। উপনির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সিপিএম প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তীর!

Advertisement

প্রয়াত প্রাক্তন শিক্ষক নারায়ণবাবুর সঙ্গে এলাকার পরিচিতি ছিল অতি নিবিড়। বিরোধীদের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন সজ্জন মানুষটি। সেই কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হল কী করে, তা নিয়ে বিস্মিত স্থানীয় মানুষও। তবে শুধু সিপিএম নয়, কংগ্রেস প্রার্থী অসিত মজুমদার এবং এসইউসি প্রার্থী অজয় বাইনেরও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের নিয়মে, কোনও কেন্দ্রে যত ভোট পড়ে, তার ছ’ভাগের এক ভাগের কম ভোট পেলে প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সেই হিসাবেই তিন প্রার্থীর এই গতি হয়েছে। বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে মোট ভোট পড়েছে ১,৮৯,৬৯১টি। এর মধ্যে নোটায় ভোট পড়েছে ১,২৫৪। কিছু পোস্টাল ব্যালট আছে। ভোটের দিন একটি ইভিএম মেশিন খারাপ হওয়ায় মাঝপথে অন্য ইভিএম মেশিনে ভোট হয়। কিন্তু সেই মেশিনটি মঙ্গলবার গণনার সময়ে খোলাই যায়নি। ওই মেশিনে ছিল ২৭টি ভোট।

Advertisement

সিপিএম প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তী পেয়েছেন ২৪,৮৮৪টি ভোট। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএম প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৬,৯১৪টি ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী অসিত মজুমদার এ বার পেয়েছেন ২১,৮৫৮টি ভোট। গত বিধানসভা ভোটে তিনি আবার নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পেয়েছিলেন ৫২,২৬৫টি ভোট। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৪,৫১৪টি ভোট। লোকসভা ভোটের নিরিখে ২০১৪ সালে বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী নুরুল হুদা পেয়েছিলেন ৪২,৫৩৬টি ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী আবদুল রহিম দিলু পেয়েছিলেন ২৪,৬২৬টি ভোট।

কিন্তু সিপিএমের এই হাল কেন?

নারায়ণবাবুর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। বিশেষ করে গ্রাম ও শহর এলাকার সংখ্যালঘুদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল যথেষ্ট। সেই সঙ্গে শহরবাসীর সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক যোগাযোগ। নারায়ণবাবুর প্রয়াণ দলের কাছে বড় ধাক্কা, সে কথা মানছেন বিভিন্ন স্তরের নেতারা। মৃণালবাবু দলের জেলা স্তরের নেতা। জেলা অফিসেই তাঁর নিত্য যাতায়াত। এলাকার মানুষের মধ্যে তাঁর যোগাযোগ কম, সে কথা স্বীকার করেন দলের একাংশ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোটের টিকিট পেয়েছেন তিনিই। দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সিপিএম বসিরহাট এলাকায় সামগ্রিক নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে। শুধু নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ই নন, সাম্প্রতিক সময়ে মারা গিয়েছেন দলের আরও দুই প্রভাবশালী নেতা। বসিরহাট ১ ব্লকের জিতেন মণ্ডল এবং বসিরহাট ২ ব্লকের প্রণব মুখোপাধ্যায়। এঁদের সাংগঠনিক শক্তির ভরসায় বার বার ভোটের বৈতরণী পেরোতে পেরেছে বামেরা। কিন্তু এই তিন নেতাই অল্প সময়ের ব্যবধানে মারা গিয়েছেন।

ক্লান্ত দীপেন্দু। জয়ের পরেও শান্ত শমীক। নিজস্ব চিত্র।

আরও একটি ঘটনা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে বামেদের অন্দরে।

বসিরহাট পুরসভায় গত বার ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। কিন্তু কিছু দিন আগে বামেদের তিন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তৃণমূলের আনা অনাস্থায় তারা দলীয় হুইপ অমান্য করে ভোট দিয়েছে তৃণমূলকেই। এর জেরে পরাজিত হন কংগ্রেসের পুরপ্রধান কৃষ্ণা মজুমদার। ওই তিন কাউন্সিলরকে দল থেকে বহিষ্কার করে বামেরা। কিন্তু তিন কাউন্সিলরের এ হেন আচরণে দলের কর্মী-সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় নেতৃত্বের উপরেই। তাঁদের আন্দোলনহীনতা এবং ভুল নীতির ফলেই ওই কাউন্সিলরেরা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছেন, এমন ব্যাখ্যাই বেশি গ্রহণযোগ্য হয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।

ক্ষোভ জমেছিল শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও। মাস কয়েক আগে হাসনাবাদে দলের এক কর্মী খুনের ঘটনায় প্রায় পনেরো দিন পরে সেখানে আসেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। তিনি বিজেপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ ধরে সভা গরম করেন। তৃণমূলকেও ছেড়ে কথা বলেননি। সভায় ভিড়ও ভালই হয়েছিল। কিন্তু গৌতমবাবু ফিরে যাওয়ার পরে দলের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, দমদমের ঠিকানা ছেড়ে হাসনাবাদে আসতে কেন পনেরো দিন লেগে গেল জেলা সম্পাদকের। মঞ্চে বসে বক্তৃতা না করে দল এখনও কেন সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় আদা-জল খেয়ে রাস্তায় নামছে না, সে প্রশ্নও ওঠে। সব মিলিয়ে শীর্ষ নেতাদের ভূমিকায় অসন্তোষ ছিল দলের একাংশে।

সব মিলিয়ে আট বারের জেতা কেন্দ্রে এ বার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সিপিএমের। কফিনে শেষ পেরেক ঢোকার মতোই, নারায়ণবাবুর এক ছেলে ভিড়েছেন তৃণমূল শিবিরে। যা দেখেশুনে এলাকার এক প্রবীন সিপিএম কর্মী বলেই ফেললেন, “দলটার তো হাঁড়ির হাল করে ছেড়েছেন নেতারাই। কত আর বৈঠক করে সমস্যার গোড়া খুঁজবেন? নেতৃত্বের ভিতই নড়ে গিয়েছে।”

ভোটের প্রচারে এক দিকে যখন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রী-অভিনেতা-গায়ক সকলকে জড়ো করে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, সেখানে বামেরা ছিল নেহাতই ম্রিয়মান। বিজেপিও তারকা-সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র রোড শো করেছে বসিরহাটে। এসেছেন দলের আর এক সাংসদ এসএস অহলুওয়ালিয়া। আসেন জাদুকর পি সি সরকার, অভিনেতা নিমু ভৌমিক, জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, খেলোয়াড় ষষ্ঠী দুলে-সহ অনেকে। কিন্তু বামেরা প্রচারে জোর দিয়েছিল ছোট মিটিংয়ের উপরে। যা জৌলুসে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল শুরু থেকেই। অন্য সব দলগুলি যখন ভোট নিয়ে দিনভর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, সেখানে সিপিএমের প্রচার ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়েছে। সব দেখেশুনে বিরোধী কোনও শিবিরের সঙ্গে বামেদের গোপন আঁতাত হয়েছে কিনা, তা নিয়েও গুঞ্জন তৈরি হয় ভোটারদের মধ্যে। বস্তুত, সিপিএমের ভোট যে হারে কমেছে, তা সেই সংশয়কেই জোরদার করেছে।

গৌতম দেব অবশ্য বলেন, “এই ভোটে গ্রামের সঙ্গে শহরের লড়াই হয়েছে। এটি রাজনৈতিক নির্বাচন হয়নি। সাম্প্রদায়িক ভাবে ভোট পড়েছে। গ্রামে সংখ্যালঘুদের বেশি ভোট। তাই ভোট গণনার ৫ রাউন্ড পর্যন্ত তৃণমূল এগিয়ে ছিল। শহরে হিন্দুদের বেশি ভোট। ফলে সেই ভোটগুলি বিজেপিতে পড়েছে। এই দুই কারণেই বিপর্যয়।” জেলা পর্যবেক্ষক তৃণমূলের জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সিপিএম-কংগ্রেসের এক অংশের ভোট পরিকল্পনা মাফিক বিজেপিতে পড়েছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement