দলনেত্রী তখন প্রার্থী-তালিকা ঘোষণা করছেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার কালীঘাটে প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।
ভোট যত এগিয়ে আসছে, কংগ্রেস-বামেদের ‘সমঝোতা’ নিয়ে তৃণমূলের উদ্বেগ যেন ততই বাড়ছে। ভোট-ঘোষণার অব্যবহিত পরেই শুক্রবার ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে তৃণমূলের সেই অস্বস্তি আরও প্রকট হল!
বারবারই বাম-কংগ্রেসের বোঝাপড়াকে ‘অনৈতিক জোট’ বলে মন্তব্য করছেন তৃণমূল নেত্রী। কালীঘাটে নিজের বাড়িতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময়ে এবং তার পরে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলে সাক্ষাৎকারেও তার অন্যথা হয়নি। তবে তার পাশাপাশিই এ দিন আরও এক ধাপ এগিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জোট-বিক্ষুব্ধ হয়ে কংগ্রেসের কিছু ছোট এবং স্থানীয় নেতা ইতিমধ্যে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সেই সম্ভাবনাকেই আরও উস্কে দেওয়ার লক্ষ্যে বিরোধী শিবির থেকে কেউ তৃণমূলে আসতে চাইলে তাঁদের আগাম স্বাগত জানিয়ে রেখেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ ছেড়ে চলে এলে তাঁদেরও গ্রহণ করব!’’ যে মন্তব্য আসলে মমতার মরিয়া মনোভাবের প্রকাশ বলেই মনে করছে বিরোধীরা।
সাম্প্রতিক কালে কংগ্রেস বা বাম শিবির ছেড়ে যে বিধায়কেরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের সকলকেই এ বার টিকিট দিয়েছেন মমতা। মুর্শিদাবাদে ইমানি বিশ্বাস, মালদহে সুশীল রায়, উত্তর দিনাজপুরে গোলাম রব্বানি, কোচবিহারে উদয়ন গুহ, পশ্চিম মেদিনীপুরে ছায়া দলুই বা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা— কেউ তৃণমূলে এসে টিকিট থেকে বঞ্চিত হননি! বিরোধীদের বক্তব্য, এর সঙ্গেই জোট-বিক্ষুব্ধদের স্বাগত জানিয়ে তৃণমূল নেত্রীর আবেদন বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘দল-বদলু’দের তাঁরা মর্যাদা দিতে প্রস্তুত! সেই সঙ্গেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, ‘‘তৃণমূল ২৯৪টি আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়েছে। এর পরে বিরোধীদের থেকে কাউকে স্বাগত জানাতে গেলে তালিকা থেকে দলের কাউকে বাদ দিতে হবে। তাতে আরও ক্ষোভ বাড়বে! তাতে তো ওঁদেরই বিপদ!’’
মমতা অবশ্য আপাতত জোট-বিপদ নিয়েই ভাবছেন। প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে বাম-কংগ্রেস-বিজেপিকে এক বন্ধনীতে এনেই তিনি বলেছেন, ‘‘বরাবর সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়েছি। সব কিছুতেই ওদের নেতিবাচক মানসিকতা। বাম-কংগ্রেসের অনৈতিক জোট তৈরি হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে ওরা জোট নিয়ে কিছু বলুক, না বলুক যায় আসে না!’’ এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার বেশ আগে থেকেই কংগ্রেসকে সিপিএমের ‘বি-টিম’ বলে কটাক্ষ করতেন মমতা। সে কথারই উল্লেখ করে এ দিন তাঁর মন্তব্য, ‘‘অনৈতিক এই জোট অনেক দিন ধরেই চলছে। আগে তলে তলে ছিল, এখন প্রকাশ্যে এল। এই জোট আমি মানি না।’’ মমতার আরও দাবি, ‘‘বিজেপিও এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বাংলায় কাজ হোক, ওরা চায় না।’’
তবে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ এবং জোট নিয়ে মমতার আক্রমণ বাম-কংগ্রেস শিবিরের তৎপরতাই বাড়িয়েছে। দু’দলই বুঝতে পারছে, দ্রুত সমঝোতা সেরে ফেলে তাঁদেরও প্রার্থী ঘোষণা করে ময়দানে নামতে হবে। রাহুল গাঁধী তাগাদা দেওয়ার পরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন। কংগ্রেসের একটি সূত্রের খবর, ৯০টি আসন পেলেও তারা সমঝোতা চূড়ান্ত করে ফেলতে পারে। আবার সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, ৭৫ থেকে আরও গোটা পাঁচেক আসন বেশি দেওয়ার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। এই অবস্থায় রফা-সূত্রে পৌঁছনোর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে বলেই দুই শিবিরের আশা।
একই সঙ্গে পরস্পরের উপরে চাপ বাড়ানোর খেলাও বজায় খাকছে। প্রদেশ কংগ্রেসের নির্বাচনী কমিটি যেমন আজ, শনিবারই বিধান ভবনে বৈঠকে বসছে। বামফ্রন্টের বৈঠক হবে রবিবার। সোমবার সিপিএমের রাজ্য কমিটি। তেমন পরিস্থিতি হলে কংগ্রেসের জন্য কিছু আসন ছেড়ে রেখে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে বামেরা।
উদ্বেগ আড়াল করতে মমতা অবশ্য এ দিন এই দাবিও করেছেন যে, বিরোধী জোট মোকাবিলায় একক ভাবেই তাঁরা প্রস্তুত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা মানুষকে একশো মনে করি। মানুষকে নিয়েই একশোর মধ্যে একশোয় লড়ব।’’ গত সাড়ে চার বছরে তাঁর সরকারের কাজের সৌজন্যেই মানুষ ফের তৃণমূলকে ফিরিয়ে আনবেন বলে আশাবাদী তৃণমূল নেত্রী। এমনকী, বিরোধীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন তিনি।
বাম-কংগ্রেস সমঝোতাকে বিঁধতে গিয়ে কেরলের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন তৃণমূল নেত্রী। কেরলে যে হেতু ১৪০টি আসনে এক দিনে ভোট, তাই মমতার কটাক্ষ, ‘‘এত টাকা খরচের দরকারই ছিল না! ওখানে তো বাম-কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক ভাগাভাগি করে নিলেই পারত। ভোট তো ওখানে প্রহসন!’’ কেরলে তৃণমূলের কার্যত কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও সেখানে তিনি ভোট-প্রচারে যেতে চান বলে এ দিন জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, কেরলের ভোট ১৬ মে। তত দিনে এ রাজ্যের ভোট মিটে যাবে।