—প্রতীকী ছবি।
‘কোক’ নিয়ে তেমন ঝামেলা নেই, সমস্যা পাকায় ‘পেপসি’গুলো!
নির্মলচরের শেষ প্রান্তে, পদ্মার বাঁকে বসে ছেলেটি অবলীলায় বলে, ‘‘কিছু বুঝলেন কর্তা? কোক মানে বড় গরু। তারা হেলেদুলে দিব্যি নেমে যায় নদীতে। কিন্তু বাছুর, মানে পেপসিগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ডাকতে শুরু করে। সমস্যাটা পাকে তাতেই!’’
লকডাউনের নৈঃশব্দ্যে বাছুরের ডাকাডাকি এ বার বড় প্রকট হয়ে উঠেছিল। মুখে দড়ির জাল পরিয়ে শেষতক সমস্যা সামলাতে হয়েছে রফিকুলকে (নাম পরিবর্তিত)। গামছায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মুখ থেকে গ্রামীণ ‘ফেসকভারের’ আড়ালটুকু এক টানে খুলে ফেলে রফিকুল এ বার বলে, ‘‘আমাকে চিনে ফেলেও কোনও লাভ নেই, মুর্শিদাবাদের চরে আমার মতো অনেক রফিকুল ইসলাম ছড়িয়ে রয়েছে!’’ মৃদু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে পাড় ভেঙে ফিরে যাওয়ার আগে সে জানিয়ে যায়, লকডাউনে পাচারে তেমন খামতি পড়েনি। গত দু’বছরের তুলনায় ‘ব্যবসা’ কিছুটা হোঁচট খেয়েছে, এটুকুই।
পদ্মার কোল বরাবর, লালগোলার চরবাবুপুর, নির্মলচর, ভগবানগোলার খান্দুয়া, জলঙ্গির কাহারপাড়া কিংবা রানিনগরের শেখপাড়া— নিশ্চুপে দেখেছে দেড় মানুষ সমান পাট খেতের আড়াল ধরে গরুর দেশান্তরি হওয়া! খান্দুয়ার ইসমাইল শেখ বলছেন, ‘‘এ ছবির কোনও বদল হয় না, এ বারও দেখেছি পাট খেত ধরে গরুর লাইন নদীর দিকে যাচ্ছে। তবে রাতের অন্ধকারে ‘লাইনম্যান’রা যখন গরু নিয়ে যায় তখন শব্দ করতে নেই। তা হলে পদ্মার জলে লাশ ভেসে উঠবে!’’ শব্দ অবশ্য করে বসে বিএসএফ, ‘হল্ট...গোলি চালা দুঙ্গা।’ পাল্টা জবাব হিসেবে গুলি ছুটে আসে পাচারকারীদের দিক থেকে। এ বছরের এপ্রিল থেকে অগস্ট— কখনও চরকুঠিবাড়ি কখনও বা রানিনগর কিংবা কাহারপাড়ার মানুষের ঘুম ভেঙে গিয়েছে ‘যুদ্ধে’র শব্দে। রানিনগরের আব্বাস আলি বলছেন, ‘‘বিএসএফ আর পাচারকারীদের গুলির লড়াইকে আমরা যুদ্ধ বলি। সে যদি শুনতেন তা হলে টের পেতেন, রাতভর বাজির মতো গুলির শব্দ!’’
শেখপাড়ার এক প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘খাতায় কলমে পাচার এখন কমে গিয়েছে। কিন্তু সীমান্তের এই গ্রামগুলিতে রাত কাটালে বুঝবেন, গরু-পাচার নিছক অতীত নয়। রাত্রি জুড়ে গরুর চলাচল, বিএসএফের সঙ্গে যুদ্ধ— বন্ধ হয়নি কিছুই। তবে স্থানীয় মানুষ এ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখায় না। জলে থেকে কে আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে চায়!’’
তাই সীমান্ত ছোঁয়া গ্রামীণ মাচায় পাচারের প্রসঙ্গ উঠলেই থম মেরে যায় আড্ডা। কাহারপাড়ার এক্রামুল শেখ শুধু ফিসফিস করে বলেন, ‘‘কাম-কারবারের (গরু পাচার) ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে নেই বাবু, ও সব বড় কর্তাদের ব্যাপার!’’ রফিকুলের মতো ‘চুনোপুঁটি’ লাইনম্যানের তেমন কদর নেই সেখানে। সে কারবার নিঃশব্দে চলে ‘বড়কর্তা’দের ছায়ায়। ডোমকলের এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘বড়কর্তারা অনেকটা অরণ্যদেবের মতো, পুলিশ-বিএসএফ তাদের ছুঁতে পারে না। লকডাউন কিংবা আনলক, যে কোনও আবহেই তাদের কারবার নিঃশব্দে চলে। মাঝখান থেকে সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ যায় লাইনম্যানদের। আর গরু নদী পেরিয়ে গেলে বড়কর্তাদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স নিঃশব্দে ফেঁপে ওঠে।’’
কোভিড আবহেও সেই চেনা নিয়মের বদল হয়নি বলে মনে করছেন জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। তিনি বলছেন, ‘‘ব্যবসায় ভাটা পড়া আর বন্ধ হয়ে যাওয়া এক কথা নয়। জেলার কয়েকটি সীমান্তে গরু পাচারে কিঞ্চিৎ মন্দা এসেছে ঠিকই। কিন্তু পুলিশ-বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে নতুন সীমান্ত খুলে গিয়েছে। আর রুজির টানে নতুন লাইনম্যানেরা সেই সব নয়া এলাকা দিয়ে পাচারে হাত পাকাচ্ছে।’’