নববর্ষের প্রথম দিন থেকে সঙ্গী হোক সতর্কতা, কোনও ‘ছদ্ম আত্মবিশ্বাস’ নয়
COVID-19

‘যে হারে করোনা বাড়ছে, সেটা অনেকটাই মানুষের তৈরি’

ঠিক এক বছর আগে দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে ভারতের অবস্থান যেখানে ছিল ২২তম স্থানে, সেখানে বুধবার দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে ভারত রয়েছে শীর্ষ স্থানে!

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৫০
Share:

প্রতীক্ষা: করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়েও লঙ্ঘিত হচ্ছে করোনা-বিধি! দূরত্ব শিকেয় তুলে অপেক্ষার লাইন। বুধবার ধর্মতলায়, রক্সি সিনেমা হলের সামনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ফিরে দেখা-১: (৩১ চৈত্র, ১৪২৬, ১৩ এপ্রিল‌, ২০২০)

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সিচুয়েশন রিপোর্ট নম্বর-৮৪ অনুযায়ী বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৭৭৩০৮৪, মৃত্যু ১১১৬৫২ জনের। ভারতে আক্রান্ত ৯১৫২ জন, মৃত্যু ৩০৮। বিশেষজ্ঞেরা করোনা আক্রান্তের সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে জানালেন যে, বিশ্বে ভারতের অবস্থান ২২তম স্থানে।

ফিরে দেখা-২: (১লা বৈশাখ, ১৪২৭, ১৪ এপ্রিল, ২০২০)

Advertisement

ডব্লিউএইচও-র সিচুয়েশন রিপোর্ট নম্বর ৮৫ জানাল যে, বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৪৪৮৬৩, মৃত্যু ১১৭০২১। ভারতে আক্রান্ত ১০৩৬৩, মৃত্যু ৩৩৯। আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে ভারত এ দিনও ২২তম স্থানে।

বর্তমান অবস্থা: (৩১ চৈত্র, ১৪২৭, ১৪ এপ্রিল, ২০২১) বিশ্বে মোট আক্রান্ত ১৩৬৯৯৬৩৬৪, মৃত্যু ২৯৫১৮৩২। ভারতে মোট আক্রান্ত ১৩৮৭৩৮২৫। মৃত্যু ১৭২০৮৫। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে ভারত প্রথম স্থানে! বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আমেরিকা, ব্রাজ়িল, তুরস্ক ও ফ্রান্সে যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার বাড়া-কমার হার যথাক্রমে ৫ শতাংশ (+), ৮ শতাংশ (-), ৩৩ শতাংশ (+) এবং ৯ শতাংশ (+), সেখানে ভারতে এই হার ৭০ শতাংশ (+)!

হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়ানো অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে রোগীর শরীরের অক্সিজেন মাপছিলেন বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক। হাসপাতালের ভিতরে করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট শয্যা প্রায় ভর্তি। তাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রোগী ভর্তির সিদ্ধান্ত নিতেই চলছে ওই অক্সিজেন মাপার কাজ। তাড়াহুড়োর মধ্যেই ওই চিকিৎসক বললেন, ‘‘মানুষের চিকিৎসা করতে হবে তো!’’

আজ, বৃহস্পতিবার পয়লা বৈশাখে শহরের করোনা-চিত্র এখন এটাই— প্রতিদিন আক্রান্তের নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়া, সেই সঙ্গে হাসপাতালের শয্যার জন্য ফের হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়া। ঠিক এক বছর আগে দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে ভারতের অবস্থান যেখানে ছিল ২২তম স্থানে, সেখানে বুধবার দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে ভারত রয়েছে শীর্ষ স্থানে!

কী ভাবে সম্ভব হল লজ্জাজনক এই উত্থান?

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রচার, প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাব, সেই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর করোনা নিয়ে বেপরোয়া মানসিকতা— এই ত্রিফলার জোরেই বর্তমানে করোনার এত বাড়বাড়ন্ত। মাইক্রোবায়োলজিস্ট বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘এই হারে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কী ভাবে একটা কারণকে নির্দিষ্ট করে বলি! দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, উদাসীনতা, না-পরোয়া মনোভাব, সব কিছু মিলিয়ে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’’

কিন্তু এমন পরিস্থিতি যে হতে চলেছে, তা গত তিন মাসে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দেখে বোঝা যায়নি। ‘‘প্রথম বার করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ বুঝতে বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার যে হারে করোনা বাড়ছে, সেটা অনেকটাই মানুষের তৈরি বিপর্যয় (ম্যান মেড ডিজ়াস্টার)। কারণ আমরা সংক্রমণ আটকানোর নিয়ম-বিধি জানলেও তা পালন করছি না।’’— বলছেন এক ভাইরোলজিস্ট।

আর এই ‘পালন না করার’ মানসিকতায় দুষ্ট রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের একটা বৃহত্তর অংশ। এক জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘দুর্ভাগ্য হল, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক সক্রিয়তা থাকলেই করোনার এই বাড়াবাড়ি আটকানো যেত। কিন্তু কোনও পক্ষই সে ব্যাপারে কোনও রকম দায়িত্ব নিচ্ছে না।’’ যার ফল ভুগতে হচ্ছে সবাইকে। শুধু তা-ই নয়, ‘প্রতিষেধক নিলেই করোনাকে কাবু করা যাবে’— জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে তৈরি হওয়া এই ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ
নিয়েও সতর্কবার্তা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শদাতা তথা ‘সেন্টার ফর ডিজ়িজ় ডাইনামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি’-র ডিরেক্টর রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলছেন, ‘‘প্রতিষেধক করোনার অভিঘাত কমাতে সাহায্য করে ঠিকই। কিন্তু প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। প্রতিষেধক নিয়েছি বলে কিছু হবে ‌না, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকা উচিত নয়।’’

কিন্তু সে-সব কথা শুনবে কে? শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের প্রধান সংযুক্তা দত্ত বলছিলেন, ‘‘শুধু ভুল ধারণাই নয়, করোনায় মৃত্যুর হার কম বলে অনেকের মধ্যে একটা ছদ্ম আত্মবিশ্বাসও (সিউডো কনফিডেন্স) তৈরি হয়েছে যে, আমার কিছু হবে না! কিন্তু নববর্ষ শুরু হোক ছদ্ম আত্মবিশ্বাসে নয়, বরং নিয়ম-বিধি মানার সতর্কতা নিয়ে!’’

ফলে এখন একটাই চাওয়া— আজ, বৃহস্পতিবার নববর্ষের প্রথম দিন থেকে সঙ্গী হোক সতর্কতা, কোনও ‘ছদ্ম আত্মবিশ্বাস’ নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement