বিচারক রাকেশ কুমার অনুব্রত মণ্ডলকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিলেন। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মধ্যরাতের মহানাটক শেষে অনুব্রত মণ্ডলকে নিজেদের হেফাজতে পেল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তা-ও তিন দিনের জন্য। রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের বিচারক রাকেশ কুমার মঙ্গলবার গরু পাচার মামলায় অনুব্রতকে আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তার আগে যদিও মঙ্গলবার রাত থেকে তাঁর এজলাসে শুনানি নিয়ে চলে মহানাটক। প্রথমে ভার্চুয়াল পরে বিচারকের বাড়িতে বসে এজলাস।
মঙ্গলবার রাতে অনুব্রতকে নিয়ে দিল্লি পৌঁছনোর পরই ইডি বিচারক রাকেশ কুমারের এজলাসে শুনানির আবেদন জানায়। বুধবার হোলি উপলক্ষে আদালত ছুটি। তাই মঙ্গলবার রাতেই তারা রাকেশ কুমারের এজলাসে ভার্চুয়ালি হাজির করায় অনুব্রতকে। রাত ১১টা ২০ নাগাদ শুরু হয় সেই শুনানি। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যেই সেই শুনানি মাঝপথে স্থগিত হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হয়, দু’পক্ষই যাবে বিচারকের বাড়ি। সেই মতো অনুব্রতকে নিয়ে ইডি আধিকারিকেরা যান রাকেশ কুমারের বাড়ি।
সংবাদমাধ্যমকে ‘বিভ্রান্ত’ করে একটা দীর্ঘ সময় ধরে ইডি বিচারকের বাড়ির উদ্দেশে দৌড়ে বেড়ায় রাজধানীর রাজপথে। শেষে রাত ১টা নাগাদ তারা পৌঁছয় অশোকবিহারে বিচারক রাকেশ কুমারের বাড়িতে। অনুব্রতের আইনজীবীও সঙ্গে ছিলেন। বিচারকের সামনে সশরীরে হাজির করানো হয় অনুব্রতকে। রাত ১টা ১০ নাগাদ সওয়াল শুরু করে দু’পক্ষ। ইডির আইনজীবী বিচারককে জানান, গরু পাচারের টাকা কোথায় গিয়েছে, তা জানার জন্য হেফাজতে নিয়ে অনুব্রতকে জেরা করা দরকার। সওয়াল জবাব শুরুর কিছু ক্ষণ পরেই অনুব্রতকে ৩ দিন ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। ইডি যদিও ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজত চেয়েছিল। গোটা পর্বে অনুব্রত সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। এমনকি, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ইডি দফতর বা সেখান থেকে বিচারকের বাড়ি— কোনও জায়গাতেই অনুব্রতকে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবও দিতে দেখা যায়নি।
বিচারকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মঙ্গলবার গভীর রাতে অনুব্রতের আইনজীবী মুদিত জৈন জানিয়েছেন, ইডির হেফাজতে থাকাকালীন রোজ হাসপাতালে তাঁর মক্কেলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। অনুব্রতের আইনজীবীরা প্রতি দিন আধ ঘণ্টার জন্য তাঁদের মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। আগামী ১০ মার্চ সকাল ১০টায় আবার ইডিকে রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে অনুব্রতকে হাজির করাতে হবে।
মঙ্গলবার রাতেই অনুব্রতকে নিয়ে দিল্লি পৌঁছেছিল ইডি। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁকে ভার্চুয়ালি হাজির করানো হয় আদালতে। ১১টা ২০ নাগাদ শুনানির শুরুতেই বিচারক রাকেশ কুমার বলেন, ‘‘অনেক দিন পরে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগ দিলাম। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে।’’ ইডির আইনজীবী নীতেশ রানা ১৪ দিনের জন্য কেষ্টকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানান। তবে অনুব্রতের আইনজীবী মুদিত বলেন, ‘‘এই মামলায় ভার্চুয়াল হাজিরা হওয়া উচিত নয়। সশরীরে হাজিরা দেওয়ার কথা।’’ ওই আইনজীবীর অভিযোগ, মক্কেলের সঙ্গে তাঁর কোনও কথা বলা হয়নি। তিনি কথা বলার সুযোগই পাননি। অনুব্রতের আইনজীবী এ-ও জানান, মঙ্গলবার টানা সফর করতে হয়েছে তাঁর মক্কেলকে। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনুব্রত অসুস্থ। তাঁকে সময় দেওয়া হোক। এখন হাজিরা বাতিল করা হোক বলে আর্জি জানান মুদিত। তাঁর সওয়াল, ‘‘কলকাতা হাই কোর্ট অভিযুক্তের শারীরিক অবস্থার উপরে জোর দিয়েছে। এই অবস্থায় মাঝরাতে হাজির করানো উচিত নয় অনুব্রতকে। এখানকার হাসপাতাল যে রিপোর্ট দিয়েছে তা-ও সন্তোষজনক নয়। অন্তত সকাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক।’’
ইডির আইনজীবী যদিও পাল্টা সওয়াল করেন। তিনি বলেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে অনেক সময় ভার্চুয়াল পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। অনুব্রতের আইনজীবীই তো সশরীরে হাজির হননি!’’ বিচারকের উদ্দেশে ইডির আইনজীবী বলেন, ‘‘তা হলে ৩০ মিনিট সময় দিন। অনুব্রতকে নিয়ে বাড়ি (আপনার) আসছি।’’ এর পরেই ঠিক হয় অনুব্রতকে নিয়ে বিচারক রাকেশ কুমারের বাড়িতে যাবে ইডি। শেষ হয়ে যায় ভার্চুয়াল শুনানি।
গত বছরের অগস্টে গ্রেফতার হন অনুব্রত। বেশ কয়েক বার জামিনের আবেদন খারিজ হয়েছে তাঁর। পরে ইডি তাঁকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। গরু পাচার মামলায় অনেক আগেই গ্রেফতার হয়েছেন অনুব্রতের প্রাক্তন দেহরক্ষী সহগল হোসেন। ইডির করা মামলার প্রেক্ষিতে তাঁকে এই মুহূর্তে রাখা হয়েছে দিল্লির তিহাড় জেলে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা বার বার দাবি করে এসেছেন অনুব্রতেরও হাত রয়েছে গরু পাচারে। যদিও তৃণমূল নেতার আইনজীবী সওয়াল করেছেন, এমন কোনও অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এর আগে দিল্লিযাত্রা আটকাতে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন অনুব্রত। কিন্তু গত শনিবার আদালত সেই আর্জি খারিজ করে দেয়। পাশাপাশি, দিল্লি এবং কলকাতা হাই কোর্টে আবেদনে তথ্যগোপন করায় ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করে। হাই কোর্ট জানায়, অনুব্রতকে ইডি দিল্লি নিয়ে যেতে পারবে। তবে তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে কলকাতার কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে। পাশাপাশি, বিমানযাত্রার সময়ও তাঁর সঙ্গে এক জন চিকিৎসককে রাখতে হবে। দীর্ঘ টানাপড়েনের পর মঙ্গলবার সকালে আসানসোলের সংশোধনাগার থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গরুপাচার মামলায় ধৃত অনুব্রতকে।